আজ ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড দিবস। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্ট নির্লজ্জ ইতিহাসের দিন আজ। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কারাবন্দিদের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হয়। কারারুদ্ধ ৭ রাজবন্দি শহীদ হলেন। খাপড়া ওয়ার্ডের বীর শহীদদের নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম-এর লেখা আর্ট নিউজের পাঠকদের জন্য:
ভুলে যাওয়াটা হবে অপরাধ
ইতিহাস কখনো কখনো এমন কতোগুলো ঘটনার জন্ম দেয়, যেগুলো কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না। এসব ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করাও উচিত না। যারা ইতিহাসকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে, ইতিহাসও সচরাচর তাদেরকে ‘ভুলে যেতে’ ভুল করে না। ২৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ দিবসে একথাটিই আজ বড় করে মনে উদয় হলো।
মনের মাঝে আগাগোড়াই যে কণ্টকসম প্রশ্নটি আমাকে বিচলিত করে চলেছে তা হলো- ৭০ বছর আগে ১৯৫০-এর ২৪ এপ্রিলের ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে যেভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের দেশ কী সেভাবে তার কথা মনে রেখেছে?
সে ঘটনার কথা কী মানুষের মনে জাগিয়ে রাখা ও জাতির পক্ষ থেকে তাকে মহিমান্বিত করে রাখার জন্য যথা প্রয়োজনীয় কর্তব্য কী রাষ্ট্র ও সমাজ যথাযথভাবে পালন করেছে? না, তারা তা করেনি। অথচ খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড হলো জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। অন্যায়, অবিচার ও নির্মম নিষ্ঠুর বর্বরতার বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের এই গৌরবগাঁথাকে অবলম্বন করে ধাপে ধাপে গণসংগ্রামের ধারা গড়ে উঠেছিল এবং স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরবর্তী সোপানগুলো।
দেশের কমিউনিস্ট, বামপন্থী ও প্রগতিশীলরা ‘খাপড়া ওয়ার্ডের‘ স্মৃতিকে জাগিয়ে রেখেছে ঠিকই। রাজশাহী জেলে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও সেখানে প্রতিবছর একবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের পুষ্পমাল্য অর্পণের অনুষ্ঠান হয় ঠিকই। ছোটখাট আলোচনা সভার ব্যবস্থা এবং লেখালেখিও কিছু যে প্রতিবছর হয় না এমনও নয়। কিন্তু,‘খাপড়া ওয়ার্ড’ হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক তাৎপর্য যতোটা, সে তুলনায় বস্তুতঃ তাকে অবহেলায় ভুলে থাকার মতো ব্যাপার করে রাখা হয়েছে। খাপড়া-ওয়ার্ড দিবসটি এমন একটি বড় ঐতিহাসিক দিন যেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিৎ। অথচ তা করা হয় না। ইতিহাসের কাছে কৃত এই ‘অপরাধের’ জন্য ইতিহাস আমাদেরকে কখনোই ক্ষমা করবে না।
খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই অবহেলা শুরু হয়েছিল সে ঘটনার পরদিন থেকেই। বুর্জোয়া ইতিহাসবিদরা ‘ইতিহাস বিকৃতির’ কাজটা খুব ভালোই করে থাকেন। কখনো তা তারা করেন তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে। আবার কখনো বা তারা তা করেন, ঘটনার ‘অনুল্লেখের’ বা ‘পাত্তা না দেয়ার’ মাধ্যমে– তাকে ভুলিয়ে দেয়ার প্রয়াসের দ্বারা। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে তেমনটিই। এই ঘটনাটিকে ইতিহাস থেকে যথাসম্ভব বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে বিগত ৬৭ বছর ধরে।
খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, এদেশে আরেকটি জেল হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সেদিন জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন কমিউনিস্টরাই চার নেতার হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিল। আমি নিজে ৫ নভেম্বর হরতাল আহ্বান ও সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের খুব কম নেতা ও কর্মীকে সেদিন পাশে পেয়েছিলাম।
কঠিন দিনগুলোতে তেমন কিছু না করে থাকলেও আাওয়ামী লীগ বর্তমানে জেলে চার নেতার হত্যাকাণ্ডের দিনটিকে নানা অনুষ্ঠান করে থাকে। এ দিনটিকে তারা ‘জেল হত্যাকাণ্ড দিবস’ হিসেবে পালন করেন। তারা বেমালুম ভুলে যান যে, প্রথম জেল হত্যাকাণ্ডটি ১৯৭৫ সালে ঘটেনি। প্রথম জেলা হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের ‘খাপড়া ওয়ার্ডে’। এই প্রথম জেল হত্যাকাণ্ডকে তারা জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস আপন শক্তিতে কথা কয়! তা শুধু বুর্জোয়া ইতিহাসবিদদের বইয়ের পাতাতে সীমাবদ্ধ থাকে না। ফলে দেরিতে হলেও, আজ ধীরে ধীরে খাপড়া-ওয়ার্ডের চিরঞ্জীব ইতিহাস জাতির সামনে উঠে আসতে শুরু করেছে।
ইতিহাসের সেই দিনটির কথা জানতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫০ সালে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের তখন সবে শুরু। বাঙালি মুসলমানরা ভাষা আন্দোলন শুরু করে দিলেও পাকিস্তানের প্রতি মোহটা তখনো তাদের সেভাবে কাটেনি। অনেকেই মনে করতো, শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন করে সরকারকে বিব্রত করা উচিত হবে না। কিন্তু কমিউনিস্টরা ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধীতাকারী। তাছাড়া, সেসময় তারা ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ শ্লোগান তুলে বিপ্লবী পন্থায় লড়াই চালাতে শুরু করেছিল। ‘ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে’ শুরু কমিউনিস্টরা থেকেই ছিলো শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল।
সে সময়টাতে পাকিস্তানের সর্বত্র চলছিল মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়নের রাজত্ব। মুসলিম লীগের সেই দুর্দান্ত ও একচ্ছত্র শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই সূচনা করেছিল কমিউনিস্টরা। সেসময় কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল একমাত্র কার্যকর বিরোধীদল। তখনও আওয়ামী লীগ গঠিত হয়নি। উত্তরবঙ্গে চলছিল ‘তেভাগা আন্দোলন’। ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল ‘টংক আন্দোলন’। সিলেটে চলছিল ‘নানকার বিদ্রোহ’। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চলছিল দেশজুড়ে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য কমিউনিস্ট ও কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী ও প্রগতিশীল লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে চলছিল প্রচন্ড দমন-পীড়নের স্টিম রোলার। তাদেরকে হাজারে-হাজারে গ্রেফতার করে ভরে তোলা হয়েছিল কারাগারগুলো। তাদের কেউ কেউ আটক ছিলেন রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে।
অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতাই হয় ছিলেন জেলে বন্দী, নয় আত্মগোপনে। সেসময় দিনের পর দিন ধরে তাদের থাকতে হয়েছে জেল আর আত্মগোপনে। জেল থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে, আর আত্মগোপন থেকে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে। কিন্তু এতোসব সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ লড়াই-সংগ্রামে তারা সবসময় ছিলেন সকলের সামনে। যারা আত্মগোপনে ছিলেন তারা পুলিশ-গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ করতেন। আর যারা জেলে ছিলেন তারাও নানা ইস্যুতে অনশন-ধর্মঘট পালন সহ বিভিন্ন পন্থায় সংগ্রাম চালিয়ে তাদের নানা দাবি আদায়ে সচেষ্ট থাকতেন। ‘কমিউনিস্টরা হচ্ছে পঞ্চম বাহিনী ও দেশের শত্রু’ এই অপপ্রচার খুব জোরেসোরেই চালাতো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ফলে এদেরকে জেলে হোক বা জেলের বাইরে হোক গুলি করে হত্যা করাটা পাকস্তানি শাসকদের অনেকটা ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছিল। জেলে অনশন হলে, মুখে নল ঢুকিয়ে খাওয়ানো হতো। এতে মরে গেলেও তাদের কিছুই আসতো যেতো না।
বন্দী অবস্থাতেও কমিউনিস্টদের সংগ্রাম বন্ধ ছিল না। নিজেদের জন্য রাজবন্দীর মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা, বাইরের গণসংগ্রামের সাথে সংহতি প্রকাশ ইত্যাদি এবং সেই সাথে অন্যান্য সব দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী ও হাজতিদের প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধ করা, ঘানি টানার কাজ বন্ধ করা, ইত্যাদি দাবিতে তারা দেশের সব জেলখানায় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এসব নিয়ে দেন-দরবার, দাবিনামা পেশ ইত্যাদি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তারা একাধিকবার একটানা দীর্ঘ অনশন কর্মসূচি পালন করেছিলেন। ঢাকা জেলে অনশনরত শিবেন রায়কে ‘ফোর্স ফিডিং’ করাতে গেলে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাজশাহী জেলেও সে আন্দোলন চলছিল। আন্দোলন দমনের জন্য জেল কর্তৃপক্ষ কয়েকজন নেতাকে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিলে উত্তেজনা চরমে ওঠেছিল।
২৩ এপ্রিল রাতে খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীরা সারারাত ধরে উদ্ভুত পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিল। সেই আলোচনা ২৪ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত চলেছিল। ফলে অনেকেই ছিলেন ক্লান্ত। সকালের চা-নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেও চলছিল আলোচনা। এমন সময় খাপড়া ওয়ার্ডে এসে হাজির হন জেল সুপার মিস্টার বিল, দুজন ডেপুটি জেলার, ডাক্তার, সুবেদার আকবর খাঁ, কয়েকজন মেটসহ প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন সিপাই। সিপাহিদের হাতে লাঠি। জেলার ওয়ার্ডের পূর্ব দিকের এক বন্দীর সঙ্গে কয়েকটি কথা বলেই তিনি হঠাৎ করে ওয়ার্ডের মূল গেইটটি বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জন জেল কর্মকর্তাও ভেতরে আটকা পড়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল নির্বিচার পুলিশী হামলা। বন্দীরা প্রমাদ গুনলেন। তারা হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা চালালেন। দরজা-জানালা আটকিয়ে দিলেন। ফলে জেল কর্তৃপক্ষের কেউ ভিতরে ঢুকতে পারলেন না। কিন্তু বাইরে থেকে গরাদ আর জানালার ফাঁক দিয়ে সিপাহিরা অনবরত লাঠি ছুঁড়ে মারতে থাকলেন। বন্দীরা ভিতর থেকে হাতের কাছে যা ছিলো তা দিয়ে আটকিয়ে আটকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কাঁসার থালা, ঘটি, বাটি, শিশি, দোয়াত ছুঁড়ে দিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে প্রতিরোধের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। অনেকে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এসবের মাঝেই শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ। শত শত রাউন্ড গুলি। খই ফোটার মতো। ক্ষণিকের মধ্যে শহীদের রক্তের স্রোতে লাল হয়ে গেল ‘খাপড়া ওয়ার্ড’।
সেদিনের সেই খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিতে আহত বন্দী কমরেড আব্দুস শহীদ ‘খাপড়া ওয়ার্ডের’ সেই রক্তলাল দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “চকিত দৃষ্টিতে দেখলাম, খাপড়ার প্রায় পঞ্চাশটি জানালায় বন্দুকের নল লাগিয়ে সিপাহিরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ উপুড় হয়ে বালিশের নীচে মাথা গোঁজার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জনে খাপড়ার ভিত যেন ফেটে চৌচির হতে চাইল। গেটের দিকে একটু চোখ পড়তেই দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠছে। আমার মাথা একটি সাপোর্টিং ওয়ালের আড়ালে বালিশের নীচে গোঁজা ছিল, পা কনুই বাইরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাঁটু দু’ফাঁক করে স্প্রিন্টার ঢুকে গেল। বালিশের নীচ থেকে দেখলাম পাশেই কমরেড হানিফের বাহুর উপরিভাগ ছিঁড়ে গেছে এবং সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। একটু পরেই কমরেড হানিফকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখি। যেন দেখলাম আমার অদূরেই কুষ্টিয়ার কমরেড নন্দ সান্যাল রক্তাক্ত শরীরে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়েছে। আমার হুঁশ হারাবার পূর্বে যতটুকু মনে আছে দেখলাম খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তের স্রোত বইছে। আমার শরীর বুক পর্যন্ত রক্তে ডুবন্ত।… গুলিবিদ্ধ বন্দীদের বীভৎস আর্তনাদের কথা আমার মনে আছে। যখন হুশ হল তখন বেলা দশটা। … সে দৃশ্য ভয়ঙ্কর। রক্তের গন্ধে মাছি এসে জুটেছে। মাছিগুলো আহতদের ঘিরে ধরেছে। …যদি কোনো কাল্পনিক নরকের ভয়াবহ চিত্র কেউ কোনোদিন কল্পনা করে থাকে তার সেই কল্পনার সঙ্গে এই দৃশ্যের সাদৃশ্য থাকবে নিশ্চয়ই; মানুষ কর্তৃক রক্তের হোলি খেলার পর মাছি এবং বালুকণার আক্রমণ শুধু এই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, পুঁজিবাদী সমাজে দেশপ্রেম এক বীভৎস অভিশাপ।”
সংক্ষেপে এই ছিলো সেদিনের সেই বিভৎস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা। সেদিন এই হত্যাকাণ্ডে যারা জীবন দিয়েছিলেন, তারা হলেন– ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গির সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃষক নেতা কম্পরাম সিং, খুলনার দৌলতপুরের ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন, বৃটিশবিরোধী সংগ্রামী সুধীন ধর, রেল শ্রমিক নেতা দেলোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, আন্দামান ফেরত বিপ্লবী বিজন সেন। তাদের সবাই ছিলেন তৎকালীন নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মী।
আহত হয়েছিলেন- আভরণ সিং, কালী সরকার, খবির শেখ, ডা. গণেশ সরকার, ভুজেন পালিত, ডা. সরকার, সত্যেন সরকার, গারিস উল্লাহ, সুধীর সান্যাল (নন্দ), লালু পাণ্ডে, শীতাংশু মৈত্র, হীরেন সেনগুপ্ত, আব্দুল হক, প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা, বাবর আলী, ফটিক রায়, শ্যামাপদ সেন, আশু ভরদ্বাজ, অনিমেষ ভট্টাচার্য, অনন্ত দেব, প্রিয়ব্রত দাস (মঞ্জু), আবদুশ শহীদ, সদানন্দ দাস, রশিদ উদ্দিন, মাধব দত্ত, নুরুন্নবী চৌধুরী, আব্দুল মনসুর হাবিবুল্লাহ, বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়, নাসির উদ্দিন আহমেদ, পরিতোষ দাশগুপ্ত, মতিলাল বর্মণ, পরিমল দাশগুপ্ত প্রমূখ। তাদেরও অধিকাংশ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মী।
‘খাপড়া ওয়ার্ডের’ হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। এমনকি এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি। ৬৭ বছর পর অপরাধীদের কাউকেই হয়তো এখন জীবিত পাওয়া যাবে না। তথাপি, ইতিহাসের কাছে ঋণমুক্ত হওয়ার জন্য এবং প্রকৃত ঘটনার সর্বাংশ বিবরণ ইতিহাসে স্বচ্ছ করে রাখার জন্য এ বিচার হওয়া উচিৎ।
‘খাপড়া ওয়ার্ড’ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। অন্যথায় কি ভাবে তারা অনুধাবন করবে যে, কি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদত চরিত্র, কি ছিল মুসলিম লীগের অত্যাচারের চেহারা, কারা তার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের নিশান উড্ডীন করেছিল, কি ছিল কমিউনিস্টদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্বরূপ।
বুর্জোয়া দলগুলোর কাছে এই ঐতিহাসিক ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ দিবসের কথা মনে করার সময় কোথায়? তাদের কর্মীরা তো বটেই, নেতাদের মধ্যেও পনেরো আনারই জানা নেই ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কি ছিল। অবশ্য এরকম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ‘খাপড়া ওয়ার্ডের’ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জেনারেল জিয়াউর রহমান অথবা শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়ার গুণকীর্তনের খুব একটি সুযোগ নেই। যে ঘটনায় দলীয় ‘সুপ্রিমোদের’ গুণকীর্তনের কোন সুযোগ নেই সে সম্পর্কে জানার কোনো প্রয়োজন অথবা সে বিষয়ে কোন উৎসাহ তাদের থাকবে কেন? কারণ, যে বিষয়ে অবগত হওয়ার কোনো বাণিজ্যিক বাজার মূল্য নেই, চলতি হাওয়ার বুর্জোয়া ব্যবসায়িক ‘বাজার রাজনীতিতে’ তা মূল্যহীন বলে বিবেচিত তো হবেই! তাই, খাপড়া-ওয়ার্ডের জেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ইতিহাসের পাতায় যথাযোগ্য মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার কাজটির সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করছে দেশের বর্তমান বাণিজ্যিক-ভোগবাদী-ভক্তিবাদী ধারার রাজনীতি লুটপাটের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল বাম-প্রগতিমুখীন রূপান্তর সাধনে সক্ষম হওয়ার ওপর।
লেখক পরিচিতি: কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম; সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।