রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক মাহাবুবুর রহমান রাসেল। দেশে ও ভারতে প্রায় সাত মাস চিকিৎসাধীন থেকে দেহত্যাগ করেছেন সোমবার দিবাগত রাতে। মাত্রইতো ৩৭ বছরের জীবন ছিল। কি এমন বেশি? উচ্চ রক্তচাপ থেকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। তারপর সাত মাসের ম্যারাথন চিকিৎসা। সব শেষে বিভাগের সহকর্মী আর শিক্ষার্থীদের কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান রাসেল। করোনাকালের জন্য ক্যাম্পাসের স্বজনরা তাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারেননি। প্রিয়জনের বিদায়ে স্বজনেরা মনের আকুতি তাই প্রকাশ করেছেন ফেসবুকের পাতায়।
শুদ্ধ সাংবাদিক তৈরির কারিগর মাহাবুবুর রহমান রাসেল-এর প্রতি আর্ট নিউজ শ্রদ্ধা জানাতে প্রকাশ করছে রাসেলের নিজ বিভাগের সহকর্মী সাজ্জাদ বকুল ও অন্য বিভাগের বন্ধু এম মাহাবুবুর রহমানের লেখা।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ডক্টর সাজ্জাদ বকুল লিখেছেন:
“আহারে জীবন! আহা জীবন / জলে ভাসা পদ্ম জীবন!”
রাসেলকে আমি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আগে চিনতাম না। ২০০৯ সালের ৩১ অক্টোবর একই দিনে রাসেল, আমি-সহ সাত জন রাবি’র গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেই। এরপরে একসাথে পেশাগত জীবনের পথ চলতে গিয়ে স্নেহভাজন এই সহকর্মীকে ধীরে ধীরে খুব আপন করে পাই।
আজ রাসেলের অকাল মৃত্যুতে ওর শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় স্যারকে নিয়ে যেভাবে স্মৃতিচারণে ফেসবুকের ওয়াল ভরিয়ে ফেলছে সেগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল ওরা ড. মাহাবুবুর রহমান রাসেলকে শিক্ষক হিসেবে যতটা ভালবাসত, আমিও বোধহয় সহকর্মী হিসেবে তার চেয়ে কম ভালবাসিনি।
রাসেল অসুস্থ হবার পরে আমাদের আরেক জুনিয়র সহকর্মী ও একসাথে যোগ দেওয়া ড. এ বি এম সাইফুল ইসলাম সুমনকে বলতে শুনেছি, ‘নোয়াখালী’কে এতোটা ভালবাসতাম তা তো আগে বুঝতে পারিনি।
রাসেলের বাড়ি নোয়াখালী হওয়ায় ওর বিভাগের বড় ভাই ও পরে সহকর্মী সুমন দুষ্টুমি করে ওকে মাঝে মাঝে ‘নোয়াখালী’ বলে ডাকত। রাসেলকে এ নিয়ে কখনো রাগতে দেখিনি।
ভীষণ মিশুক মানুষ ছিল রাসেল। সব কাজে অত্যন্ত দায়িত্বশীল, যত্নপরায়ণ, গোছালো আর যে কোনো ধরনের অন্যায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদকারী হিসেবে আমাদের মধ্যে রাসেল ছিল সব সময় এগিয়ে। এই অল্প সময়ের জীবনেই অনেক কিছু অর্জন করেছিল রাসেল, ওর মেধা, শ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে।
হঠাৎ এক ঝড়ে ওর সাজানো বাগান সব তছনছ হয়ে গেল। দিব্যি সুস্থ, সবল একটা মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে (যেটা আগে জানা যায়নি) মস্তিষ্কের শিরা ছিড়ে অকালেই পৃথিবীকে চিরবিদায় জানালো।
রাসেল মাঝেমাঝেই বলত, আহা জীবন, জীবন এতো ছোট কেন?
আমি, রাসেল, সুমন ও আমাদের আরেক তরুণ সহকর্মী বাকী বছর দেড়েক আগে ভুটানে গিয়েছিলাম বেড়াতে। তখন ফারুকীর ছবি ডুব-এ চিরকুটের সুমীর গাওয়া ‘আহারে জীবন! আহা জীবন, জলে ভাসা পদ্ম জীবন!’ গানটা হিমালয় পাহাড়ের মেঘঢাকা পথে গাড়িতে কতবার যে শুনেছে রাসেল, আর বিড়বিড় করে গেয়েছে।
রাসেল কী বুঝতে পারছিল ওর জীবন জলে ভাসা পদ্মই?
রাসেল, তোমার বুকের ধন শিশুকন্যা প্রজাপতি আর তোমার জীবনসঙ্গী পনিকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা জানা নেই। ওদের কী সান্ত্বনা দেব? নিজেকেই তো সান্ত্বনা দিতে পারছি না।
কত শখ ছিল একসাথে সম্প্রীতি নামে যে বাড়িটা করলাম আমরা ১০ জন মিলে, সেখানে সবাই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে দিন কাটাব, তা আর হলো না। আমার নিচের তলার ফ্ল্যাটে তোমার প্রজাপতি আর পনি থাকবে, ওদের দেখে কীভাবে সামলাব নিজেকে?
ভাল থেকো ভাই, যেখানে থাকো। এই করোনাকালের দুর্যোগে রাজশাহী থেকে ঢাকা-নোয়াখালী গিয়ে তোমাকে শেষ দেখাটা দেখা হলো না আমাদের কারোরই। এই কষ্টও তাড়িয়ে বেড়াবে অনেকদিন।
ডিপার্টমেন্ট অব ফিসারিজ-এর শিক্ষক এম মাহাবুবুর রহমান লিখেছেন:
“ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
ভাই রাসেল দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলা!
বড্ড তাড়াতাড়ি গেলা ভাই!
তোমার হাস্য উজ্জল মুখটি নিয়ে
পরপারেও ভাল থাকো শান্তিতে থাকো ভাই!
*
তোমার জয়েন করার ২য় দিনে পরিচয়!
শিক্ষক জীবনের আড্ডার অনেকটা সময়
তোমার সাথে কাটিয়েছি ভাই!
আর হবে না নোয়াখাইল্লা আর হলুদ
সাংবাদিক বলে ক্ষেপানো!
আর হবে না সন্ধ্যার পর জোহা
চত্ত্বরে এক চক্কর ঘুরে আসা!
*
মাহাবুবুর রহমান রাসেল
মাহাবুবুর রহমান রতন
সিনিয়র হলেও অনেকেই জানত এরা ২ জন ভাল বন্ধু!
একটা সময় রতনকে দেখলে রাসেলের কথা
জিজ্ঞেস করত অনেকেই!
ভিসি স্যার সে দিনও জিজ্ঞেস করেছিলেন
রাসেলের কি খবর!
*
ভাই শুনছেন!
ভাই আপনি জানেন কি!
ভাই এরকম না!
ভাই দল না করলে কে করবে!
ভাই সবাই না বললে কি করার বলেন!
ভাই আপনে একটু বলেন!
ভাই চলেন হেঁটে আসি!
ভাই আপনার জুতা অনেক দিন টিকে!
ভাই এবার কাজটা সেরে ফেলেন!
ভাই শরীরের খেয়াল রাখেন!
এই রকম হাজারো কথা হইছে তোমার সাথে!
আর কোনো দিনই শুনা হবে না তোমার মুখ
থেকে এমন কথা… ভাই!
*
আল্লাহ তুমিই সব চাইতে ভাল জান
কোনটি কার জন্য ভাল!
আমাদের প্রার্থনা… আল্লাহ তমি এই ছেলেটিকে
মাগফেরাত দান কর… তাকে জান্নাত দান কর…
ছেলেটির পরিবার বিশেষ করে
ছোট মেয়েটিকে হেফাজতে রেখো… আমীন।”