করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম না করার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। সীমিত করা হয়েছে মুজিব জন্মশতবোর্ষিকীর আয়োজন। লাখো মানুষের জমায়েত স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু জনসমাগম ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সাথে অভিভাবকদের দাবি উপেক্ষা করেই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।

করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি তুলেছেন অভিভাবকরা। কিন্তু মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না। প্রায় এক সপ্তাহ আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। তাদের পরামর্শ পেলেই বন্ধ করা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ১১৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত সোয়া কোটি।
এরই মধ্যে চীন ও ইতালিসহ যে সব দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে সেসব দেশ দেশে প্রবাসীরা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। এতে আতঙ্ক বাড়ছে। বিশেষত দেশে ফেরা প্রবাসীরা কোয়ারেন্টাইনে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনায় আতঙ্ক আরো বেড়েছে।
স্কুল কলেজ বন্ধ না হওয়ায় অভিভাবকদের মাঝে দিন দিন অস্বস্তি বাড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতির হার কমতে শুরু করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। অন্য দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন হাম রুবেলার টিকা দেয়া কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, স্কুল কলেজ বন্ধ করার চিন্তা ভাবনা চলছে। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর পাল্টা হিসেবে অভিভাবকরো বলছেন, পরিস্থিতি খারাপ হলে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে বন্ধের ঘোষণা দেয়া যৌক্তিক না। চীন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালিসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ইতোমধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এখনই সময় স্কুল কলেজ বন্ধ করার।
রাজধানীর কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলছেন, সরকার বন্ধ ঘোষণা না করায় তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে না পাঠালে তারা কিছু বলবেন না।

সরকারের পক্ষ থেকে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অথচ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ প্রতিষ্ঠান ভেদে প্রতিদিন ২০০ থেকে শুরু করে ৩০/৩৫ হাজার মানুষের সমাগম হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সাথে লক্ষাধিক অভিভাবক প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যাচ্ছেন। তাই এমন জনসমাগম ঠেকানোর একটাই পথ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্তত দুই বা তিন সপ্তাহ বন্ধ রাখা।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক অভিভাবক আর্ট নিউজকে জানান, বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রশাসন করোনা সংক্রমণ কোন পর্যায়ে পৌঁছুনোর অপেক্ষা করছে? তিনি স্কুল কলেজ বন্ধের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারও বন্ধের দাবি জানান।
রাজধানীর হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একজন শিক্ষক আর্ট নিউজকে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সুযোগ নেই। কেউ চাইলে বাচ্চাকে স্কুলে নাও পাঠাতে পারেন। শিক্ষার্থীর যে অ্যাসেসমেন্ট বাকি থাকবে তা আমরা পরে নিয়ে নিব।
রাজধানীর একটি সরকারি কলেজে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা কেন শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবো। বর্তমান পরিস্থিতিতে যত বেশি ঘরে থাকা যাবে তারা তত নিরাপদ থাকবে।
এদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের প্রধান মুখপাত্র বদরুল আলম জানিয়েছেন, সারা দেশে প্রাথমিক ও এবতেদায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২৮ থেকে ৩০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে অন্তত দুই সপ্তাহ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত।
নালন্দা স্কুলের এক অভিভাবক জানালেন, তিনি তার মেয়েকে স্কুলে দেয়া বন্ধ করেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে না পারলেও অভিভাবকদের এমন সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহে তার নিজের প্রতিষ্ঠান মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলে গত এক সপ্তাহে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমেছে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। তিনি বলেন, কোন অভিভাবক নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলে আমরা জোর করতে পারি না। প্রত্যেক অভিভাবকের কাছে তার সন্তানের সুরক্ষা বেশি জরুরী।
রাজধানীর সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের এক অভিভাবক জানিয়েছেন, তিনিও তার ছেলেকে স্কুলে দিচ্ছেন না। ছেলের বেশ কয়েকজন বন্ধুও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার বিষয়ে তারা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর মতামতের অপক্ষোয় আছেন। সেখান থেকে মত পেলেই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।