বাংলাদেশে সোমেন চর্চা

৮ মার্চ সোমেন চন্দ দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তরুণ সাহিত্যিক ও রেল শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা সোমেন চন্দ নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন রেভ্যুলেশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি (আরএসপি) ও ফরোয়ার্ড ব্লকের হামলায়। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ পুরনো ঢাকার হৃষিকেশ দাস রোডে (কলরেডি মাইকের অফিস ছাড়িয়ে কালী মন্দিরের সামনে। এখন সেখানে একটি কদম গাছ আছে)। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যেমনটি সাম্প্রতিককালে ডক্টর হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজিব ও অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে মুক্তচিন্তার অপরাধে।

দাঙ্গা, বনস্পতি, ইঁদুর তার বিখ্যাত গল্প। সম্পাদনা করেছেন ক্রান্তি নামের সাহিত্য পত্রিকার। তাঁর মৃত্যুতে, পরের বছর ১৯৪৩ সালে ক্রান্তির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধে লিখলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। পূর্ব বাংলার কোন সাহিত্য পত্রিকায় সুকান্তের সেটিই প্রথম প্রকাশিত কবিতা। সোমেন চন্দ তাঁর মাত্র একুশ বছরের জীবনে বেশ কিছু আলোচিত গল্পের পাশাপাশি লিখেছেন একটি উপন্যাস ‘বন্যা’। এছাড়া কয়েকটি কবিতা ও কথিকাও লিখেছেন তিনি। সাহিত্য জগতে তাঁর বন্ধু ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, রবি গুহ’র মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। সতীশ পাকড়াশী সোমেন চন্দকে উৎসাহী করেছিলেন গণসাহিত্য লিখতে।

সোমেন চন্দ সম্পর্কে জানতে বরেণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ পড়ার বিকল্প নেই। এছাড়া ডক্টর হায়াৎ মামুদ বাংলা একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালা সিরিজে লিখেছেন এই ক্ষণজন্মা প্রতিভাকে নিয়ে। ডক্টর সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষসহ এখন অনেকেই সোমেন সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন। সোমেন চন্দের ছোট ভাই, কোলকাতার বাসিন্দা কল্যাণ চন্দ ৯০ পেরুনো বয়সেও খুঁজে ফেরেন অগ্রজের লেখা।

১৯৩৯ সালে কোলকাতায় গড়ে উঠেছিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ। ঢাকায় সোমেন চন্দের আগ্রহে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪১ সালে। সোমেনের মৃত্যুর পর এই সংঘের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ। পরে, এই সংগঠনের সাথে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সক্রিয় কর্মি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, প্রয়াত দার্শনিক অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বরা।

১৯৮৯ সালে সদ্য কৈশোর পেরুনো ৫ তরুণের চেষ্টায় ঢাকায় গড়ে ওঠে সোমেন সংসদ। সাংবাদিক নজরুল কবীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ হাফিজুর রহমান, আইনজীবী নেতা সৈয়দ মামুন মাহবুব, ব্যবসায়ী সত্যজিৎ সূত্রধর ও সাংবাদিক গবেষক রহমান মুস্তাফিজ (এই লেখার লেখক) প্রায় ২০ বছর পর ঢাকায় আয়োজন করলেন ৮ মার্চের অনুষ্ঠান।

সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। আলোচক ছিলেন ডক্টর হায়াৎ মামুদ, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, সাংবাদিক শুভ রহমান, আবু নাহিদ, কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বরা। অনুষ্ঠানে কাঁচা হাতে লেখা প্রবন্ধ উত্থাপন করেন রহমান মুস্তাফিজ। যা কয়েকদিন পর দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। শিল্পী প্রবীর দাশগুপ্ত অনুষ্ঠানের জন্য জলরঙে একটি পোট্রেট এঁকে দেন। অনুষ্ঠানের জন্য ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ আয়োজকদের তিন শ’ টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকায় মাইক ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মেটানো হয়।

এই অনুষ্ঠানটিকে নিয়েই অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম দৈনিক সংবাদে উপ-সম্পাদকীয় লিখেন। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের তিনি তাঁর লেখায় অবিহিত করেন ‘সাহিত্যের প্রত্নতাত্ত্বিক’ হিসেবে।

এর আগে ১৯৬৯ সালে ঢাকায় শেষ বারের মতো ৮ মার্চ সোমেন চন্দকে স্মরণ করা হয়েছিল। সৃজনী নামের একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজকদের অন্যতম ছিলেন আবু নাহিদ ও তাঁর সাংবাদিক বন্ধু শুভ রহমান ও কামাল লোহানী। বনস্পতি গল্প অবলম্বনে নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয়। নাটকের অভিনয় শিল্পী ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ডক্টর ইনামুল হকের মতো তরুণ শিল্পীরা। মঞ্চ সজ্জার জন্য (সেট) একটি নৌকার দরকার হয়। উল্লিখিত ব্যক্তিরা সদরঘাট থেকে একটি নৌকা নিজেরাই বহন করে এনেছিলেন।

অনুষ্ঠানটি বটতলায় (এখন যেখানে নজরুল মঞ্চ) করতে বাংলা উন্নয়ন কেন্দ্রের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) অনুমতি চাইলেন সৃজনীর সংগঠকরা। বাংলা উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন একজন অবাঙালি। সে সময় সরদার ফজলুল করিম সে প্রতিষ্ঠানে উপ-পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। অবাঙালি পরিচালক সরদার ফজলুল করিমের কাছে জানতে চাইলেন ‘কে এই সোমেন?’ যার জন্য অনুষ্ঠান করতে চাইছেন কিছু তরুণ। সরদার ফজলুল করিম সংক্ষেপে সোমেন চন্দ সম্পর্কে বললেন। পরে অনুমতি মিললো অনুষ্ঠান করার। এ ফাঁকে সরদার ফজলুল করিম দৈনিক সংবাদে উপ-সম্পাদকীয় লিখলেন। শিরোনাম দিলেন ‘কে এই সোমেন?’

সোমেন সংসদের পক্ষ থেকে ১৯৯৫ সালে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ১৭ জন বিপ্লবীকে সম্মাননা জানানো হয়। এদের মধ্যে এ মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে পড়ছে: রণেশ দাশগুপ্ত, ইলা মিত্র, কবিয়াল ফনি বড়ুয়া, কামাল খাঁ, প্রসাদ রায়, অমল সেন, সুনীল রায়, কামালউদ্দীন খাঁন, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, শান্তি দত্ত ও হেনা দাস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন সাংবাদিক কামাল লোহানী।

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সম্মাননা জানাতে কামাল লোহানীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় কমিটি। সেই কমিটি কাজ করতে গিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি করে। ফলে অনুষ্ঠানের পর বিলুপ্ত করা হয় সোমেন সংসদ।

এক বছর বিরতির পর ১৯৯৭ সালে রহমান মুস্তাফিজ আবারও সোমেন চন্দকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্র নাম নিয়ে নতুন করে পথ চলার শুরু। সে বছরের মার্চে সোমেন পদক দেয়া হয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমকে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষক ও নারী নেত্রী হেনা দাস। পরের ফেব্রুয়ারিতে (১৯৯৮) প্রকাশিত হয় সাহিত্য ও গবেষণাপত্র ‘ক্রান্তি’। সোমেন চন্দের রেখে যাওয়া নামে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদনায় ছিলেন রহমান মুস্তাফিজ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর পাঠাগারের নামকরণ করা হয়েছে সোমেন-তাজুল পাঠাগার নামে। সোমেন চন্দের মতো তাজুল ইসলামও ফ্যাসিবাদী হামলার শিকার হয়ে নিহত হন। ১৯৮৮ সালের ১ মার্চ আদমজীতে নৃশংস ভাবে খুন হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নতকোত্তর ডিগ্রীধারী তাজুল ইসলাম আদমজী পাট কলে বদলী শ্রমিকের কাজ করতেন শ্রমিক শ্রেণীকে বিপ্লবী ধারায় সম্পৃক্ত করতে।

এছাড়া ১৯৯৬ সালে রাজধানির জুড়াইনে গড়ে তোলা হয় সোমেন চন্দ পাঠাগার।
নিতট অতীতে সোমেন চন্দকে নিয়ে ডক্টর সফিউদ্দিন আহমেদ, আমিনুর রহমান সুলতান, জাকির হোসেনসহ আরো কয়েকজন গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। আমিনুর রহমান সুলতান গত কয়েক বছর ধরে সোমেন চন্দের নামে একটি পদক প্রবর্তন করেছেন, যা প্রতি বছর ৮ মার্চ প্রদান করা হয়।
আলোকচিত্র সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা পাভেল, সাবেক ছাত্রনেতা বিকাশ সাহাসহ কয়েকজনের চেষ্টায় ঋষিকেশ দাস রোডে সোমেন চন্দের শহীদ হওয়ার স্থানটি যতোটা সম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *