শৈশবের পয়লা বৈশাখ সবার কাছেই অসাধারণ সুখ স্মৃতি। এমন স্মৃতি কখনও ফিকে হয় না। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়নি তখনও। কিংবা পয়লা বৈশাখে বাঙালিয়ানার নামে পান্তা-ইলিশের অসভ্যতাও শুরু হয়নি। এমন সময়কার বৈশাখী স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন রহমান মুস্তাফিজ:
আমরা তখন কলতাবাজারের বাসায় থাকি। সে সময়ের পয়লা বৈশাখে ঘুম থেকে তুলে দেয়া হতো কাকডাকা ভোরে। গোসল সেরে নাস্তা খেতে বসে যেতাম সকাল ৬টা সাড়ে ৬টার মধ্যেই। আমরা মাটিতে পাটি বিছিয়ে খেতাম। মুখোমুখি থাকতো দু’টি পাটি। মাঝে নাস্তার প্লেট, বাটি, বোল। আব্বা বসতেন একটা পাটির ঠিক মাঝখানটায়। আমি আব্বার গা ঘেষে বসতাম। আম্মা বসতেন আব্বার ঠিক উল্টোপাশে। তাতে সবার পাতে খাবার তুলে দিতে সুবিধা হতো।
নাস্তার মেন্যুটা একটু লম্বাটে ছিল। মুড়ি, খই, চিড়া ধোয়া প্রধান আইটেম। এর সাথে যোগ হতো দই, মাঠা, গুড় আর চিনি। ফলের মধ্যে থাকতো পাকা আম, কলা, কাঁঠাল, তরমুজ আর বাঙ্গি। মিষ্টির আইটেম বলতে রসগোল্লা, কালোজাম আর মনসুর।
নাস্তার পর আব্বার সাথে বের হতাম। প্রথমেই নিজেদের প্রেসে। সেখানে হালখাতার আয়োজন। ১৮ ইঞ্চি বাই ৫ ইঞ্চি লম্বা খাতা। ওপরটা মোড়ানো থাকতো পাতলা লাল কাপড়ে। নতুন বছরে শুরু হতো সেই খাতায় প্রেসের আয়-ব্যয়ের হিসাব লেখা। ও হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখের আগের ১০/১২ দিন আব্বার ব্যাপক ব্যস্ত সময় কাটতো।
বাসাতেও খাটের ওপর একটা কাঠের টুল (জলচৌকি) নিতেন। আব্বা খাটে বসে টুলের ওপরে হিসাবের খাতা রেখে সারা বছরের হিসাব মেলাতেন। আমাদের তখন জোরে কথা বলা, চিল্লা-চিল্লি… সব নিষিদ্ধ। আব্বা পুরো বছরের হিসাব মেলাতেন। লাভের হিসাব শেষে কর্মচারিদের বোনাসের হিসাব করতেন।
আমাদের সুরুচি প্রেসে কর্মকর্তা ছিলেন দুই জন। এক জন ম্যানেজার আরেকজন ছিলেন ফোরম্যান। আর সিজনের বাইরে নিয়মিত কর্মচারি ছিলেন ১৪/১৫ জন। কর্মচারিরা মানে, কম্পোজিটর, মেশিনম্যান, হেলপার ও পিয়নরা বৈশাখে বোনাস পেতেন। খুব বড়ো প্রেস ছিল না আমাদের। একটা ৩৬ ইঞ্চি চাইনিজ সেমি-অটো কাটিং মেশিন, একটা ভিক্টোরিয়া অটোমেটিক মেশিন, চায়না হাফ ডিমাই ট্রেডেল মেশিন (পরে এটা বিক্রি করে আমেরিকান স্যান্ডেলপ্রাইস ট্রেড্রেল কেনা হয়) আর ডবল ক্রাউন ফ্লাট মেশিন নিয়ে ছিল আব্বার প্রাতিষ্ঠানিক সংসার। পরে একটা শর্ট ডবল ডিমাই অফসেট মেশিন যোগ হয় এ বহরে। শীশার তৈরি টাইপে ছাপার কাজ হতো তখন। ছবি হতো জিঙ্ক ব্লকে, পরে নাইলো। একসাথে ১৬ জন কম্পোজিটর কাজ করতেন সিজনের সময়। নির্বাচনী মৌসুমে কাজ করতেন অন্তত ৩০ জন কম্পোজিটর। কারণ তখন নতুন বছরের বইয়ের কাজের পাশাপাশি নির্বাচনের কাজও করতে হতো। তবে ফুল সিজনে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) কর্মচারির সংখ্যা ৩ শিফটে একশ’ ছাড়াতো।
সবমিলিয়ে প্রেসের হালখাতাটা বেশ ভাল জমতো। আমাদের প্রেস থেকে বের হয়ে আব্বার সাথে যেতাম পাশের ‘জাহানে নও’ আর ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান’ প্রেসে। এরপর নয়াবাজারে হান্নান অ্যান্ড সন্স (কাগজ আর কালির দোকান), বাংলাবাজারের ৩/৪টি প্রেস, ৫/৬টা প্রকাশনীতে যেতাম। খেতে পারতাম না, পেট ভরা থাকতো। আব্বার বন্ধদের প্রেসগুলোতে খাওয়ার জন্য জোর করতো না। মিষ্টি দিয়ে দিত প্যাকেটে করে। সেটা ছিল আরেক যন্ত্রণা। তবে বেশিক্ষণ আমাকে সেই যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না। কারণ, তখন কেউ কাউকে কিছু দিলে পরিমাণে অল্প দিত না। একেকটা প্রেস বা প্রকাশনী সংস্থা থেকে নানা রকমের দেড় দুই সের (তখনও কেজি পদ্ধতি চালু হয়নি) মিষ্টি, লাড্ডু বা মনসুর দিত। একটা সময়ে এসে ৮/১০ কেজি হয়ে যেত। কোন এক প্রেসে হয়তো একটা ব্যাগ দিত মিষ্টি বহনের জন্য। আব্বা সব মিষ্টিই নিতেন। বলতেন, মানুষ ভালোবেসে দিলে কষ্ট হলেও নিতে হয়।
এই মিষ্টি বাসায় এনে কিছুটা রাখা হতো। বাকিটা প্রেসের কর্মচারিদের দিয়ে দেয়া হতো বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
দুপুরে দেড়টা নাগাদ বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরে খাবার খাওয়া খুব কষ্টকর একটা কাজ হতো। তবে ছোটবেলা থেকেই ভোজন রসিক ছিলাম বলে চোখের ক্ষুধা নিয়েই বসে যেতাম খেতে।
থাকতো নানাপদের ভর্তা-ভাজি। ভূনা খিচুড়ি (ভাইয়ার পছন্দের, মূলত মুগডাল দেয়া পোলাও) অথবা পোলাও (আমার পছন্দের)। গরু-মুরগি-খাসী… মাংস থাকতো তিন পদেরই, মানে গরু, খাসী আর মুরগি। আব্বা বলতেন, ‘বছরের প্রথম দিনের খাবারটা ভালো হওয়া চাই, দেশি হওয়া চাই।’
খাবারের পর আব্বা একটা ভাতঘুম দিতেন। ওই ফাকে টুক করে পালাতাম। চলে যেতাম রঙিন দুনিয়ায়। মানে, ধোলাইখালে। সেখানে হতো বৈশাখী মেলা। মেলায় ঘুরতাম। চরকিতে (নাগরদোলা) চড়তাম। টুকটাক কেনাকাটা সেরে যেতাম দীঘির পাড়ে। সেখানে নৌকায় এপাড় ওপাড় চলতো অনেকে। ৫ পয়সা করে নিত মাঝি। সাতার জানি না বলে চড়িনি কখনও। তবে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম।
বাসায় ফেরার পথে ২ টাকায় (শেষবার কিনেছি ৫ টাকায়) লঞ্চ কিনতাম। শরিষার তেল দিয়ে সলতেতে আগুন দিয়ে একধরনের হাতলওয়ালা চারকোণা কুপি জ্বালাতে হতো। সেটি লঞ্চের ভিতরে একটা পাতের নিচে রাখতে হতো। পাত গরম হয়ে ভটভটিয়ে চলতো সেই লঞ্চ। দারুণ রোমাঞ্চকর এক খেলনা। আমার দেখা আজও পৃথিবীর সেরা খেলনা।
আরেকটা খেলনা কেনা হতো। টিনের তৈরি পিস্তল। দাম ছিল প্রথমে ৫০ পয়সা। শেষবার কিনেছি ৬ টাকায়। কাগজের কার্টিজ পাওয়া যেত। ভিতরে এক চিমটি বারুদ। ট্রিগার টিপলে টাশ টাশ করে শব্দ হতো। বারুদ পোড়া গন্ধের সাথে বাতাসে খানিকটা ধোয়াও উড়তো। আমরা টিনের পিস্তল দিয়ে দারুণ সব যুদ্ধ জয় করেছি। হিটলার, মুসোলিনিকে অনেকবার মেরেছি সেই পিস্তল দিয়ে। ও হ্যাঁ, ওই পিস্তল দিয়ে শরীফ স্যারকেও খুন করেছি। শরীফ স্যার ইংরেজির টিচার ছিলেন। খুব কড়া। মারতেন অনেক। স্যার পড়ানোতে যতোটা নোযোগী ছিলেন, মার দেয়ায় তারচেয়ে বেশি সময় নিতেন। ছাত্রদের মারাটাকে স্যার শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই স্যারকে টিনের পিস্তল দিয়ে গুলিতে গুলিতে ঝাঝরা করে দিতাম।
গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠের মেলায় দু’একবার গিয়েছি। ধোলাইখালের মতো আপন মনে হয়নি কখনো সে মেলাকে। হতে পারে সেটা ভিন্ন এলাকার বলে। দূরত্বটাও একটা ব্যাপার ছিল। তাছাড়া এতোদূরে একা যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। ছিল পথ হারাবার ভয়। তখন আবার ছেলেধরার উৎপাতও ছিল।
আব্বা শুধু নয়, তখন একটা কথা প্রচলিত ছিল, বছরের প্রথমদিন ভাল খেলে সারা বছরই ভালো খাবার জুটবে। তাই এতো আয়োজন। আমাদের এই আয়োজন ছিল পয়লা বৈশাখের নিয়মিত আয়োজন। কিন্তু অনেক বছর গেছে যখন সারা বছর আমরা এতো ভালো ভালো খাবার খেতে পারিনি। বরং নিজের যুগে এসে টাকার অভাবে খেতে পারিনি, এমন দিনও পার করেছি।
আব্বা নেই। আমাদের
সেই বৈশাখী আয়োজনও নেই। আব্বা যাওয়ার পর আর কখনও আয়োজন করে বৈশাখী খাবার খাইনি। আর
কখনো খাবোও না। খেতে পারবো না। আর্থিক সামর্থ্যের সমস্যা নেই। কিন্তু বৈশাখী খাবারের
আয়োজনটা যে আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে আব্বা করতেন সেটা আর কখনোই পাওয়া যাবে না।
লোক দেখানো খাবারের আয়োজনের সাথে বাঙালিয়ানার আবেগ-ভালবাসার মিশ্রণে যে আয়োজন, তাতে
ফারাক বিস্তর। তাই লৌকিক আয়োজনে ভরপুর বৈশাখী খাবার আমাকে টানে না। বরং প্রতিবছর বৈশাখটা
শুরু হয় মন খারাপ দিয়ে। বুকের মাঝে কান্নার ঢেউ কেউ দেখে না। সত্যিই কী কেউ দেখে না?
দেখে, অবশ্যই দেখে। আব্বা যেখানেই থাকুন না কেন, সবার চোখ এড়ালেও আব্বার চোখ নিশ্চয়ই
এড়ায় না। তিনি ঠিকই আমার মনের সবটুকু পড়ে ফেলেন।