রাজু, ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস

রহমান মুস্তাফিজের মুক্তমত: রাজু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসের প্রমিথিউস। রাজু, মঈন হোসেন রাজু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সবাই তাকে মেধাবী বলে। কোন শিক্ষার্থী মারা গেলে বা নিহত হলে আমাদের গণমাধ্যম তাকে মেধাবী আখ্যা দেয়। আমি রাজুকে মেধাবী বলছি না। এই বিশেষণটা রাজুর জন্য নয়। মেধাবী না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান কেন, কোন বিভাগেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। বরং রাজু ছিলেন সৃজনশীল। তার অসাধারণত্ব ছিল কথায় ও কাজে। এই রাজুকে মেরে ফেলা হলো। রাজুদের আসলে মেরে ফেলতে হয়। নাহলে দ্রোহ আর দ্রাহের আগুনে ঝলসে যায় সব নষ্ট আর অন্ধত্ব।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। সেদিন শেষ বিকেলে সবাই যখন সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, রাজু তখন গর্জে ওঠে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। এক দিকে যখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বন্দুক যুদ্ধে প্রকম্পিত ক্যাম্পাস, অন্য দিকে রাজুর নেতৃত্বে গগনবিদারী স্লোগান ওঠে এই নারকীয়তার বিরুদ্ধে।

হাবিবুন নবী সোহেলের (বর্তমানে বিএনপি’র ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক) নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অস্ত্রধারীরা হাকিম চত্বর থেকে তখন গুলি ছুড়ছে। ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা তখন জগন্নাথ হল ও শামুন্নাহার হলের আড়ার থেকে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এই অবস্থায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মঈন হোসেন রাজু। টিএসসি-তে তখন গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যে যে কয়েকজন নেতাকর্মী ছিলেন, রাজু তাদের সংগঠিত করেন। বের করেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিছিল।

মিছিল যখন ডাস আর রোকেয়া হলের মাঝের রাস্তা অতিক্রম করছে, তখনই ঘাতকের তপ্ত বুলেট থামিয়ে দেয় রাজুর গতি। থমকে যায় মিছিল। সহযোদ্ধাদের কাঁধে ভর করে রাজু রিকশায় ওঠে। রিকশা ছোটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। অথচ রাজু একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের ভার নিতে চেয়েছিল নিজের কাঁধে।

সেদিনের কথা বেশ মনে পড়ে। রাজু যখন গুলিবিদ্ধ হন, আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২, আব্বা সড়ক দুর্ঘটনার পর ঢামেক হাসপাতালে। রাতে ৩০ নাম্বার ওয়ার্ডে আব্বার পাশে আমি থাকি, দিনেও থাকার চেষ্টা করি। ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফজলে রাব্বির বাবাও হাসপাতালে। সন্ধ্যায় আমি দোতালায় ২ নাম্বার ওয়ার্ডে রাব্বীর বাবার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে নিচে নামলাম। সিঁড়ির গোঁড়ায় দেখা হলো ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কামাল পাশার সাথে। বললেন, ‘রাজু গুলি খেয়েছে। ৩২ নাম্বার ওয়ার্ডে আছে।’

রাজুর গুলি খাওয়ার কথা জানার পর আর কিছু শুনলাম না। কেন জানি ছুটলাম কলেজ ভবনে সন্ধানী কার্যালয়ের দিকে। রোজার মাস, ইফতারি শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। রফিককে (পরে সন্ধানীর সভাপতি হয়েছিলেন) খুঁজে বের করে সন্ধানীর গেট খোলার ব্যবস্থা করলাম। ততোক্ষণে অনেকে এসে ভিড় করেছেন রক্ত দিতে। রক্ত নেয়া শুরু হওয়ার পর গেলাম রাজুর কাছে। গিয়ে শুনলাম সংগৃহীত রক্ত রাজুর কোন কাজে আসবে না। বন্ধু আমার চলে গেছে শুকতারা হয়ে। দিনটি ছিল ১৩ মার্চ ১৯৯২।

আজ  মঈন হোসেন রাজুর চলে যাওয়ার ২৮ বছর।

রাজুকে নিয়ে পরদিন শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘পুরাণের পাখি’ নামের কবিতাটি। রাজু নিজেও ছিলেন কবিতানুরাগী। ডায়েরীর পাতায় পাতায় লিখে রাখতো পছন্দের পঙতিগুলো। রাজু তার শহীদুল্লাহ হলের ১২২ নম্বর রুমের দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিল জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘মনে হয় একদিন’। এই কবিতার শেষ লাইনটি “শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কী আকাশ?” ছিল রাজুর খুব পছন্দের। ডায়েরীর শুরুতেও সে লাইনটি লিখে রেখেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আজ অনেকেই হয়তো বক্তৃতা করবেন, তাতে কী আসে যায় রাজুর, রাজুর পরিবারের অথবা আমরা যারা রাজুর বন্ধু বা সহযোদ্ধা ছিলাম তাদের? এখন কি আর কেউ জানে, রাজুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআদালত কার্যক্রম বন্ধের ষড়যন্ত্র হয়েছিল? যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে তৎকালীণ বিএনপি সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে যে অজুহাত খুঁজছিল তা তারা পেয়েছিল রাজু হত্যার মধ্যদিয়ে।

১৪ মার্চ ১৯৯২, রাজু হত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে শোকমিছিল। দীর্ঘ সেই মিছিলের প্রথম অংশ যখন লেকচার থিয়েটারের সামনে, শেষ ভাগ টিএসসি-তে। এমন সময় হামলা হলো সেই শোক মিছিলে। দিকবিদিক ছুটতে গিয়ে আহত হলেন ছাত্র ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।

এর আগের দিন সকালে রাজুর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল টিএসসিতে। সারারাত হাসপাতালে বাবার পাশে কাটিয়ে সকালে গিয়েছিলাম টিএসসি। রাজু জনতা ব্যাংকের সামনে একটি টেবিল নিয়ে বসেছিল। তাতে ছিল চলন্তিকা বই ঘরের সহায়তায় তার প্রকাশিত ‘প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি গাইড’ এবং প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টারের ফরম। সবাই যখন বাণিজ্যিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করাতেন কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে, রাজু তখন সেচ্চঅশ্রমের ভিত্তিতে চালু করেছিলেন ভর্তি কোচিং, মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে। রাজুর সাথে কথা বলছি, খুনসুটি করছি। এমন সময় গণআদালত কার্যক্রমের সপক্ষে মিছিল বের করে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড। কামাল পাশা চৌধুরী ও পরাগের নেতৃত্বে সেই মিছিল টিএসসি অতিক্রম করার সময় শুরু হয় গোলযোগ। এরপর আমরা কে কোনদিকে যাই জানি না। যাওয়ার আগে সবাই হাতে কয়েকটি করে গাইড বই নিয়ে নেই তা রক্ষার জন্য। গোলযোগ থেমে গেলে আমরা আবার ফিরে আসি টেবিলের কাছে।

রাজুকে হত্যা করার পর বিশ্বদ্যিালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতে ভাঙেনি প্রতিরোধের দেয়াল। বরং বেরিকেডে বেরিকেডে রুদ্ধ হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের পালাবার পথ। ২৬ মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত রায় দেয় হিংস্র গোলাম আযমের ১৯৭১-এ করা অপরাধে ফাঁসির দণ্ড। রাজুর মৃত্যু গণআদালতের আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিল।

ভাস্কর শ্ল্পিী শ্যামল চৌধুরী মমতায় গড়ছেন রাজু ভাস্কর্য। শ্যামল চৌধুরী যে মুখাবয়ব নিখুঁত করছেন হাতের স্পর্শে, সেটিই মঈন হোসেন রাজুর প্রতিকৃতি।

রাজুর স্মরণে আমরা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ পরে টিএসসি-তে গড়ে তুলেছিলাম ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’। এই ভাস্কর্যে রাজুরও একটি প্রতিকৃতি আছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে মুখ করে, ঘাড় একদিকে কাৎ করে যে প্রতিকৃতি, সেটিই মঈন হোসেন রাজুর ছবি দেখে করা। ফিগারের অংশে মডেল হয়েছিলেন রাজুর বড়ভাই মুনিম হোসেন রানা। এছাড়া বাকি সাতটি ফিগারে রানা, রিপন, শাহিনা আকতার শীলু, উৎপল দত্ত, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, রাজু, সাঈদ হাসান তুহীন ও হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল এই ভাস্কর্যের মডেল। ভাস্কর্য শিল্পী শ্যামল চৌধুরী এর প্রাথমিক কাজটি করেন মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টের আঙিনায়। ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করা হয় ১৯৯৭ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর, শিক্ষা দিবসে।

রাজু ভাস্কর্য এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন সংগ্রামের স্মারক হয়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলন মানেই এখন অপরাজেয় বাংলা আর রাজু ভাস্কর্য।

মঈন হোসেন রাজু, তার প্রিয় ছিল সজীব নামটি। বন্ধুর ভালো লাগবে বলে তাকে আমি সজীব নামেই ডেকেছি তার জীবনের শেষ দুইটি বছর। রাজু সজীব থাকতে চেয়েছিলেন বিপ্লব আর বিপ্লবীদের মাঝে। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সমাজকল্যাণ সম্পাদক কর্মীদের মাঝে সজীবতা ছড়াতেন। হতাশ কর্মীদেরও দেখেছি, রাজুর সংস্পর্শে এলে কেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠতেন। সজীব নামটা তাই শুধু রাজুকেই মানাতো।

সজীব (রাজু) বন্ধু আমার… নির্বোধ ঘাতক জানে না, মরনেই থামে না জীবন। তোমাকে সালাম। বেঁচে থেকো হাজার বছর, শুকতারা হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *