শহীদ বাবাকে নিয়ে…

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর তিন ছেলেও জড়িত সাংবাদিকতার সাথে। এঁদেরই একজন জাহীদ রেজা নূর। সংবাদ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন প্রথম আলোতে। এছাড়া “কণ্ঠশীলন”-এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে করছেন সংস্কৃতিসেবা। জাহীদ রেজা নূর আজ ফেসবুকে লিখলেন শহীদ বাবাকে নিয়ে। ঠিক নিজের লেখাও নয়… ১৯৭১-এ আমাদের বিজয়ের ঠিক একদিন পর দৈনিক ইত্তেফাক বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যে সংখ্যা প্রকাশ করেছিল তারই একটি রিপোর্ট নিয়ে এ লেখা, যা আর্ট নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

“এ আমার জন্য এক আবিস্কার। আজই প্রথম দেখলাম, ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের যে টেলিগ্রামটি বেরিয়েছিল, সেটা।
টেলিগ্রামে লেখা ছিল, অন্য অনেক অপহৃত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। সেই টেলিগ্রামের প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হয়েছিল, কার্যনির্বাহক সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন (এই বানানেই)।
তখনও ক্ষীণ আশা ছিল, তিনি হয়ত ফিরে আসবেন।

টেলিগ্রামের লেখাটা কম্পোজ করে দিলাম।

দৈনিক ইত্তেফাক ডিসেম্বর ১৮
বিশেষ সংখ্যা। দাম ১০ পয়সা।
১৬শ বর্ষ, ২১তম সংখ্যা
শনিবার ২ পৌষ, ১৩৭৮, ডিসেম্বর ১৮, ১৯৭১

শিরোনাম ছিল:

সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড

ঢাকায় শতাধিক সাংবাদিক সাহিত্যিক অধ্যাপক চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী নিহত


দৈনিক ইত্তেফাক গভীর দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করিতেছে যে, পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর চরম দক্ষিণপন্ধী জামাতে ইসলামীর চণ্ড বাহিনী আল বদর ও আল শামস্ ঢাকার যেসব বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, লেখক ও চিকিৎসককে পতনের পূর্ব মুহূর্তে অপহরণ করিয়েছিল তাহাদের প্রায় সকলেই এই ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাইয়াছে। আজ (শনিবার) ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সী পরিবেশিত এক খবরে বল হয়: দখলদার পাক বাহিনীর শেষ নৃশংসত গণহত্যার নির্মম শিকার সোনার বাংলা দেশের বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঢাকার শহরতলী রায়ের বাজারের অদূরবর্তী খানা–খন্দ, ইটের গাদা ও গর্তে ইতিহাসের এই জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের সবগুলিই পেছনে হাত বাঁধা এবং বুক ও মাথায় গুলী ও বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন। অনেকগুলির চোখ উপড়ানো। অনেকগুলি মৃতদেহ শকুন, শৃগাল কাক ও কুকুরের আহার্যে পরিণত হইয়াছে। অনেকগুলির শুধু কংকাল ছড়াইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সমগ্র এলাকা পুঁতিগন্ধে বিষাক্ত।
একটি গর্তে অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, ডা. ফজলে রাব্বি এবং ডা. এ. খায়েরের মৃতদেহ গত শুত্রবার বিকালে সনাক্ত করা হয়। আজ (শনিবার) সকালে বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়–স্বজনগণ এই নৃশংস বধ্যভূমির খবর জানিতে পারিয়া ঘটনাস্থলে গিয়া মৃতদেহসমূহ সনাক্ত করিতে শুরু করেন।
বিশ্ব সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিও নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিগণ ঘটনাস্থলে গিয়া বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির প্রত্যক্ষ করেন। তাঁহারা বন্দিশিবির তথা ফিজিক্যাল ট্রিনিং ইনস্টিটিউট–এর বহু কক্ষ এখনও রক্ত রঞ্জিত অবস্থায় দেখিতে পান এবং এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হাতিয়ার সমূহও ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত দেখিতে পান।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে সামরিক জান্তা ও চরম দক্ষিণপন্থী জামাতে ইসলামীর ফ্যানাটিকদের নিয়া গঠিত রাজাকার, আল বদর ও আল শামস এইসব বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করিয়া লইয়া যায়। যে সব বুদ্ধিজীবী দখলদার বাহিনী ও তার দোসরদের শেষ ছোবলের শিকার হইয়াছেন বলিয়া অনুমান করা হইতেছে, তাহাদের মধ্যে আছেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহক সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, পিপিআই–এর জনাব নিজামুদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নাজমুল হক, সাপ্তাহিক ললনার সাবেক ম্যানেজিং এডিটর জনাব মুহম্মদ আখতার, দৈনিক অবজারভারের জনাব এস এ মান্নান, দৈনিক পূর্বদেশের জনাব এ এস এম গোলাম মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. আবুল খায়ের ও অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমদ, গণিত শাস্ত্র বিভাগের অধ্যাপক সাদউদ্দীন, ড, মনিরুজ্জামান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী ও আরও অনেকে।”