দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার দেবব্রত মুখোপাধ্যায় করোনাজয়ী সৈনিক। বাসাতেই আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়েছেন তিনি। নিজের ফেসবুকে তিনি দিয়েছেন এমন সুসংবাদ। তার এই সংগ্রাম প্রেরণা জোগাতে পারে করোনা আক্রান্ত অন্যদেরও। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন:
পজেটিভ থেকে নেগেটিভ: আমার করোনা পর্ব
“হ্যাঁ, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ফিরে এসেছি।
১ মে ভোর বেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছিলাম। অভ্যেস বশত মোবাইলটায় চোখ দিলাম। দেখি আইইডিসিআরের একটা মেইল। সংক্ষিপ্ত করে লেখা: কোভিড-১৯ পজেটিভ।
আমি বা আমার বৌ মুখে আর শব্দ করিনি।
বিছানা থেকে উঠে এলাম। একটা রুম ফাঁকা করা হলো। সেই রুমে ঢুকে গেলাম। সেই থেকে এখন অবধি সেই রুমটাতে বসে আছি। শুধু পার্থক্য, এখন আমার ছেলে, মেয়ে, বৌ; আমার বুকের কাছে। কারণ, আজ ফোনে আমাকে জানানো হলো, আমার রিপোর্ট নেগেটিভ হয়েছে।
এর মাঝখানে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, অসহ্য এবং উপাসনাময় এক জীবন কাটালাম।
এই পুরোটা সময় আমার ভরসা ছিলেন স্রষ্টা।
২৮ এপ্রিল রাতে যখন প্রথম জ্বর এলো, তখনই আমি আশিকুর রহমান অপুকে ফোন দিয়েছিলাম। আমার এই যোদ্ধা ভাইটা সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে নিজে তখনও পুরো সুস্থ হয়নি; কথা বলতে কষ্ট হয়। এর মধ্যে আমার জন্য ডাক্তার থেকে শুরু করে পথ্য, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এই ১৬টা দিন আমি অপুর তত্ত্বাবধায়নে ছিলাম। তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করবো না।
আমার দ্বিতীয় অবলম্বন ছিলেন ডাক্তার নাহিদ।
আমার বোন ১৯৭১ সালে মারা গেছেন; আমি দেখিনি। মাঝে মাঝে ভাবার চেষ্টা করি, সে থাকলে আমার জন্য কী করতো? নাহিদ বুঝালেন, কী করতো।
একজন পেশাদার ডাক্তার হিসেবে তিনি ওষুধ দিয়েই কাজ শেষ করতে পারতেন। তিনি আমার খাবার, চলাফেরা থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন।
প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে চার জন মানুষ ফোন দিতেন- অপু, নাহিদ, আমার দুই ভাই।
আমার দুই বড় ভাই সম্ভবত আমার মতোই কষ্ট পেয়েছে। তারা ব্যাকুল হয়ে ছিলো আমার জন্য। আমি এর আগে কখনো তাদের কণ্ঠে এই আকুলতা দেখিনি।
এই পুরোটা সময় আমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা বকবক করে আমাকে টিকিয়ে রেখেছে আহমেদ খান হীরক। দারুনভাবে সমর্থন দিয়েছে সাইফ ও শোয়েব।
আরিফুল ইসলাম রনি সাধারণত রোগশোককে পাত্তা দেয় না। সেও দেখি ওয়েবসাইট ঘেটে আমার জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিধি খুজে খুজে পাঠাচ্ছে।
আমার বস মোতাহের হোসেন মাসুম ভাই আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ দেন। এই সময়ে সেটা আরও বেশী পেয়েছি। প্রতিদিন উদ্বিগ্ন হয়ে খবর নিয়েছেন।
ইত্তেফাক পরিবার অসম্ভব শক্ত হয়ে আমার পাশে ছিলো। মালিক পক্ষের একজন শাওন ভাই থেকে শুরু করে প্রায় সকল সাংবাদিক, কর্মী আমাকে ফোন করে করে সাহস দিয়েছেন।
আমার এক কলিগ পলাশ আমার প্রতিবেশী। সে এই লক ডাউন ভেঙে আমার বাসায় ওষুধ কিনে দিয়ে গেছে। নিত্যদিন জিজ্ঞেস করেছে, কী লাগবে?
স্থানীয় স্বপ্ন আউটলেটের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ মামুন শক্ত হয়ে পাশে ছিলেন ও বাজার করে পাঠিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন।
সবার কাছে কৃতজ্ঞতা।
শুধু কৃতজ্ঞতা জানাবো না আমার বৌ আর ছেলে-মেয়ে আর শ্যালকের কাছে। ওদের ওপর দিয়ে কী গেছে, সে আমি জানি।
আমার শ্যালক অমিত বাবু এই ঝুকি নিয়ে আমার রুমে এসেছে, থেকেছে। সে তার জীবনটাই বাজি রেখেছে আমার জন্য।
প্রতিটা দিন আমার ছেলেটা দরজার কাছে দাড়িয়ে দিন গুনেছে। আর মেয়েটা কেঁদে কেঁদে বলেছে, ‘‘বাবা, একটু জড়াই ধরি?’
ঈশ্বরকে আবারও কৃতজ্ঞতা জানাই, আরেকবার ওদের জড়িয়ে ধরতে দেওয়ার জন্য।
যাদের কথা বললাম না, বুঝবেন, তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।
যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের জন্য শুভকামনা রইলো। আপনাদের জন্য নিজের অভিজ্ঞতাটা কিছু লিখে জানাবো।
* আমার ক্রিকেট ও ক্রীড়া পরিবার এবং সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কথা উল্লেখ করা দরকার। মাশরাফি থেকে শুরু করে অনেক খেলোয়াড়, সংগঠক বারবার খোঁজ নিয়েছেন। আমার পাশে ছিলেন ডিআরইউ ও অন্যান্য সংগঠনের কর্মকর্তারা। তারা আমার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
[বাসার বাকীদের সবার রেজাল্ট নেগেটিভ]”