অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ

0
618

স্কুলের টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে করোনাকালে টিউশন ফি অর্ধেক করার দাবিতে সংগঠিত হচ্ছেন অভিভাবকরা। তাদের দাবি, এক মাসেরও বেশি সময় স্কুল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এরপর শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। ফলে যে সব ইস্যু দেখিয়ে স্কুলের অতিরিক্ত বেতন নেয়া হতো সে সব খাতে স্কুলের খরচ হচ্ছে না। ফলে বেতন কমানোর উচিত। একই সাথে অভিভাবকরা বলছেন, করোনার কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। যারা চাকরিতে আছেন তাদের অনেকেরই পুরো বেতন পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই। এ অবস্থায় টিউশন ফি ও নতুন শিক্ষাবর্ষের পুণঃভর্তি ফি ৫০ শতাংশ কমানো উচিত।

রাজধানীতে অভিভাবকদের মানববন্ধন

দেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের সংগঠিত করার মাধ্যম হিসেবে। ফেসবুকে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরাম’। ইতোমধ্যেই এই গ্রুপে প্রায় ১০ হাজার অভিভাবক যুক্ত হয়েছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ পুরো বেতনের জন্য চাপ দিচ্ছে। বেতন জমা না দেয়ায় কোন কোন স্কুলে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাসে যুক্ত করা হচ্ছে না। কিছু স্কুলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। আবার কোন কোন স্কুল পরীক্ষার ফল জানাচ্ছে না।

অভিভাবকদের কাছ থেকে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। মিরপুরের হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একজন অভিভাবক জানালেন, তার ছেলের স্কুলে ২ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত ছিল নতুন ক্লাসের রি-অ্যানরোলমেন্ট। নতুন ক্লাসের ভর্তি ফি অথবা মাসের বেতন এক টাকাও কমানো হয়নি। স্কুল থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে, আপনাদের (অভিভাবকদের) কথা বিবেচনা করে রি-অ্যানরোলমেন্ট ফি ও মান্থলি ফি একটুও বাড়ানো হয়নি। কমানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জবাবে বলা হয়, কমানো বা বাড়ানো হয়নি, আগের বছরের নির্ধারিত ১৫ হাজার টাকার পুরোটাই রি-অ্যানরোলমেন্টের জন্য দিতে হবে।

ওই অভিভাবক জানান, মার্চের ১৮ থেকে এপ্রিলের ২৫ তারিখ পর্যন্ত স্কুল বন্ধ ছিল। এরপর শুরু হলো অনলাইন ক্লাস। সাড়ে ৪ ঘন্টার স্কুলের সময়সীমা নেমে আসে দেড় ঘন্টায়। স্কুলের বিদ্যুৎ, এসি, পানি-সহ আনুষাঙ্গিক খরচ লাগেনি এই তিনমাসে। বছরের শুরুতে জমা দেয়া সব স্টেশনারী সামগ্রিও (টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশও বাদ যায়নি। প্রায় ৪ হাজার টাকার স্টেশনারি সামগ্রি বছরের শুরুতে জমা দিতে হয়) ব্যবহৃত হয়নি। তারপরও তারা পুরো ফি নিবে। ২০২০-২০২১ শিক্ষা বর্ষে অর্ধেকরও বেশি সময় হয়তো অনলাইনেই ক্লাস হবে। আবার পুরো বছরটাও চলে যেতে পারে অনলাইন পদ্ধতিতে।

ওই অভিভাবক জানান, মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত বেতনেও ছাড় দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। জুলাই ২০১৯ – জুন ২০২০ শিক্ষাবর্ষে কেজি ওয়ানে বেতন ছিল সাড়ে ৪ হাজার টাকা। পুরো বেতন শোধ করতে হয়েছে। রি-অ্যানরোলমেন্টের জন্য দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। তিনি জানান, ওই স্কুলে এর আগের বছর একই ক্লাসে মাসিক টিউশন ফি ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা। রি-অ্যানরোলমেন্ট ফি ছিল ১৪ হাজার টাকা। এক বছরের ব্যবধানেই বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সব ধরনের ফি।

অভিভাবকদের প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ করে দেয়া হার্ডকো স্কুল কর্তৃপক্ষের চিঠি

এটা শুধু হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, রাজধানীর প্রায় সব স্কুলেরই একই চিত্র। বরং কোন কোন স্কুলে মে/জুন মাসে যখন অনলাইনে পরীক্ষা নিয়েছে, তখন প্রতি বিষয়ের জন্য এক থেকে তিন শ’ টাকা পর্যন্ত ফি আদায় করেছে। পরীক্ষা হয়েছে অনলাইনে। তার জন্য প্রশ্ন ছাপানো বা খাতা তৈরি করতে হয়নি। শিক্ষকদের খাতা দেখতে হয়নি। তাহলে কেন পরীক্ষা ফি নেয়া হলো?

রাজধানীর ইস্কাটনে অবস্থান ইউনেভার্সাল টিউটোরিয়াল। স্কুলটিতে করোনার কারণে এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া অনলাইন ক্লাস হয়েছে সপ্তাহে ৪ দিন। সে স্কুলের একজন অভিভাবক জানালেন, টিচাররা ওই চারদিন শুধু হোমওয়ার্ক দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন। সন্তানের পড়াশোনার পুরোটাই বাবা-মা’কেই করাতে হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী ওই অভিভাবক জানান, নতুন ক্লাসে ভর্তির জন্য কোন ছাড় দেয়া হয়নি।

রাজধানীর মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজেরও একই অবস্থা। ৭ জুন থেকে অভিভাবকদের চাপে সপ্তাহে একদিন রোববার একঘন্টা অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। রোববার যে হোম ওয়ার্ক দেয় বৃহস্পতিবার সেটা জমা দিতে হয়। অনলাইনে যা যা পড়া দেয়, বাইরে থেকে প্রিন্ট করে হোম ওয়ার্ক করে ছবি তুলে ফাইল করে আপলোডাতে হয়। মাসিক বেতন ৪ হাজার ৪২০ টাকা। টাকাটা দিতে হয় বিকাশে। বিকাশের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নেয়া সত্ত্বেও সার্ভিস চার্জের নামে আরও ৬০ টাকা করে নেয়া হয়।

হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের আরেক অভিভাবক জানান, “রি-অ্যানরোলমেন্টের জন্য স্কুল থেকে ফোন পেলাম। তাদের ফি কমাতে বললাম। এ বিষয়ে পরে জানাবে বললো। পরে ফোন করে জানালো, এ বছর কোন ফি (অ্যানুয়াল, মান্থলি) বাড়ানো হবে না। জানতে চাইলাম, কমিয়েছেন কী? বললো, কমাইনি। বাড়ানোও হয়নি।

তিনি জানান, “কর্তৃপক্ষকে বললাম, আপনাদের সাড়ে ৪ ঘন্টার ক্লাস দেড় ঘন্টায় ঠেকেছে। সব অনুষ্ঠান বন্ধ। আউটিংও হবে না। ৮ তলা ভবনের এসি’র বিল লাগছে না, লিফট চলছে না। এগুলো ফি থেকে বাদ দেয়া যায়।

তারা উত্তর দিল, এগুলো হবে।

– কবে?

: নভেম্বর/ডিসেম্বরে হবে।

– করোনা ততোদিন দূর হবে?

: ওটাতো আল্লাহ জানে।

– যা জানেন না তা মাথায় রেখে ফি নিয়ে ভাবছেন না কেন?

: এসব অনুষ্ঠান না হলে টাকা সমন্বয় করা হবে।

– সমন্বয়ের ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কি? যদি হয় তখন ফি নিলেই হবে।

এরপর কথা বাড়াতে আগ্রহী হয়নি স্কুলের পক্ষ থেকে ফোন করা ব্যক্তিটি।”

আরেক অভিভাবক জানিয়েছেন, রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিভাবকদের কাছ থেকে পুরো ফি নিয়েও শিক্ষকদের বেতন ঠিক মতো দেয়া হয়নি।

ফেসবুকে অভিভাবকরা তাদের দাবির সমর্থনে পোস্ট দিচ্ছেন এভাবেই

রাজধানীরই আরেকটি স্বনামখ্যাত স্কুলের একজন অভিভাবক আর্ট নিউজকে বললেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো একেকটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তারা ইচ্ছেমতো টিউশন ফি নেয়, প্রতিবছর ইচ্ছেমতো টিউশন ফি বাড়ায়। এদের জন্য সুস্পষ্ট কোন নীতিমালা নেই, থাকলেও ওরা তা মানে না। প্রতিবছর রি-অ্যাডমিশন ফি বাবদ বেশ বড় অংকের টাকা এরা আমাদের থেকে নেয়। সরকার থেকে রি-অ্যাডমিশন ফি বন্ধ করতে বলায় তারা মাসের বেতনের সাথে রি-অ্যাডমিশন ফি যোগ করে ৪ থেকে ১১টা কিস্তিতে বছরের বেতন ভাগ করে দিচ্ছে, ফলে আমাদের উপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে।’

ওই অভিভাবক দাবি করেন, ১) স্কুলগুলোর রি-অ্যাডমিশন ফি নেয়া বন্ধ করতে হবে। ২) মাসের টিউশন ফি মাসে নিতে হবে। ইন্সটলমেন্টের নামে অন্যান্য ফি যোগ করে টিউশন ফি নেয়া যাবে না। ৩) স্কুলগুলোর মধ্যে টিউশন ফি-র সামঞ্জস্য থাকতে হবে। স্কুলের ক্যাটাগরি অনুযায়ী টিউশন ফি নির্ধারণ করা যেতে পারে। এবং ৪) প্রতি বছর টিউশন ফি বাড়ানো বন্ধ করতে হবে।

ইতোমধ্যেই রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলের অভিভাবকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিছু স্কুলের অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। অভিভাবকরা সংগঠিত হচ্ছেন বেশ ভালোভাবেই।

এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। অনেকে নতুন ক্লাসে ভর্তি করাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। প্রয়োজনে তারা আন্দোলনে যাবেন, এমন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক অভিভাবক বলছেন, সরকার যদি এখনই কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেন তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ধস নামবে।

মানারাত স্কুলের অভিভাবকদের সমাবেশের ভিডিও লিংক:

https://www.facebook.com/fahmidarisaat.barsha/videos/pcb.219865069062856/4226602047379941/?type=3&theater&ifg=1