জাহীদ রেজা নূর: রশীদ হায়দার, আমরা যাকে রশীদ কাকা বলে তৃপ্ত হতাম, তিনি মরিয়া হয়ে আমাকে একটা অনুরোধ করেছিলেন। নিজেই ফোন করে বলেছিলেন, কাজটা যেন আমি করি।
আমি কথা রেখেছিলাম। প্রসঙ্গটি ছিল ‘স্মৃতি ৭১’ নিয়ে। সে কথা বলব পরে।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দশটি বছর আমি কাটিয়েছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সে সময় এই ঘটনাগুলো দূর থেকেই শুনতে হয়েছে। আমি তার অংশ হতে পারিনি।
সে সময়টিতে আন্তরিকভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কাজ যারা করেছেন, তাদের মধ্যে রশীদ হায়দার অন্যতম।
দেশে ফিরে আসার পর যখন চাকরি খুঁজতে লাগলাম। তখন কেউ একজন বাংলা একাডেমির কথা বলেছিল। সেখানে ছিলেন তখন রশীদ হায়দার এবং সেলিনা হোসেন। তাঁদের দুজনেরই ইচ্ছা ছিল, আমি যেন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি। সে সময় মহাপরিচালক ছিলেন মনসুর মুসা। আমাকে তাঁরা দুজন মিলেই নিয়ে গিয়েছিলেন মনসুর মুসার কাছে। মনসুর মুসা আপত্তি করেননি। অ্যাডহক ভিত্তিতে সাড়ে আট হাজার টাকা বেতনে আমাকে নেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই মনসুর মুসার চাকরি চলে যায় এবং তাঁর জায়গায় আসেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। এবারও তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে যান রশীদ হায়দার এবং সেলিনা হোসেন। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, অ্যাডহক ভিত্তিতে নয়, সার্কুলার দিয়েই আমাকে নেওয়া হবে। ‘এরপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা কেটে গেলো’, সার্কুলার আর হলো না। এক সময় প্রচণ্ড রকম আর্থিক সংকটে পড়ে সংবাদে চাকরি নিলাম। সংবাদে উপ-সম্পাদকীয় লিখতাম বলে সংবাদের সোহরাব হাসান আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঠিক সে সময় হাসান মামুন সংবাদ ছেড়ে দেওয়ায় একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, যেখানে আমার চাকরি হয়েছিল। সেই থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ততা।
সাংবাদিকতার সুবাদেই এরপর রশীদ হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি সংবাদে লিখতেন। কখনো কখনো সেই লেখা আনতে বাংলা একাডেমিতে যেতাম।
মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ পরিবার বিষয়ে রশীদ কাকার আন্তরিকতার শেষ ছিল না। আমি তাঁর মিরপুরের মিল্কভিটার বাড়িতে গিয়েছি। যেখানেই দেখা হয়েছে আমি তার স্নেহ পেয়েছি। অনেক মানুষই কৃত্রিমভাবে কিছু কথার আদান প্রদান করে থাকেন, রশীদ হায়দার সেই কৃত্রিমতার ধার ধারতেন না। তিনি যখন কথা বলতেন, বুঝতাম, এই স্নেহ একেবারে হৃদয় থেকে উঠে এসেছে।
পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল ধরে যে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সেখানে বহুদিন রশীদ হায়দার অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিলেন। আবার এক সময় তিনি সেখানে ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। সেসময় আবার তাঁর লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে। মার্চ বা ডিসেম্বর এলে স্বভাবতই আমি তার কাছ থেকে লেখা চাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু সব সময় অনুমতি মেলেনি।
সংবাদপত্রের হালচাল বুঝতেন বলে তিনি আমার উপর কখনো রাগ করেননি। আমাকে ফোনে বলতেন, কোন এক বিষয়ে লিখেছেন, পাঠাতে চান আমাদের পত্রিকায়। যখন অফিসের তরফ থেকে নেতিবাচক উত্তর পেয়েছি, তখন নানা ছলে বলে তাকে সে খবরটি দেওয়ার সময় আমার যে আত্মগ্লানি হতো, তা থেকে এখনো মুক্ত হতে পারিনি। তিনি রাগ করতেন না, বুঝতেন, সেটাই ছিল সান্ত্বনা।
প্রথমে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে কথা এবার বলি। শমী কায়সার একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে। বারবার অনুরোধ করেছে, এ বিষয়ে যে অনুষ্ঠানটি হবে, তা যেন আমি উপস্থাপন করি। আমি রাজি হয়েছিলাম।
সে অনুষ্ঠানে মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান কক্ষে হয়েছিল অনুষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানটির কথা আগাম জানতে পেরে রশীদ হায়দার আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেছিলেন, স্মৃতি৭১ বহুদিন আগে থেকেই বাংলা একাডেমিতে মজুদ নেই। সেটা আবার বের করা দরকার। এ কথা যেন আমি শামসুজ্জামান খানকে বলি। এবং তা যেন উপস্থাপনা করার সময় সবাই যাতে শুনতে পায় সেভাবে বলি।
এর আগে নাকি অনেকবার বলা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। তিনি খুব করে চান, শহীদ সন্তান হিসেবে আমি যেন এই অনুরোধটা রাখি।
আমি খুবই আনন্দ চিত্তে তার কথা রাখবো বলে কথা দিয়েছিলাম।
আমি তাকে দেওয়া কথা রেখেছিলাম।
শামসুজ্জামান খান, তিনিও আমাকে স্নেহ করেন, শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে দেওয়া বক্তৃতায় মধ্যেই বলেছিলেন, অবশ্যই স্মৃতি ৭১-এর পুনর্মুদ্রণ করবেন।
কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে দেখেছি, পুনর্মুদ্রণ হয়েছে বইটির।
নিশ্চয়ই রশীদ কাকা খুশি হয়েছিলেন তাতে।
শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে আজ স্মরণ করছি।
লেখক পরিচিতি:
জাহীদ রেজা নূর; সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান