বিএমইটি খুলে দেয়া দরকার

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এর বিকল্প নেই

0
428

আবু রায়হান সরকার: বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ রোধে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশ সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংক্রমণের প্রায় শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছেন। পৃথিবীর কোনো দেশই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ, সংক্রমণের বিস্তার ও সংক্রমণ জনিত মৃত্যু নিয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পারে নাই। তা সত্ত্বেও সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই ভাইরাসের বিস্তার রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। বহুল আলোচিত লকডাউন থেকে শুরু করে নানা যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রক্রিয়া হিসেবে সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। ফলতঃ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বেকারত্বের হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

করোনাকালের প্রায় ষোল মাসে বহুসংখ্যক উচ্চবিত্ত নেমে এসেছে মধ্যবিত্তের কাতারে। মধ্যবিত্ত নেমে এসেছে নিম্নবিত্তের কাতারে। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষের আর্থিক ও পেশাগত চরম সংকটের সময়েও দেশের অর্থনীতিকে তরতাজা করে ধরে রেখেছে ফরেন রেমিট্যান্স। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত পঞ্চাশ বছরে দেশ দারিদ্র্যের বেঞ্চমার্ক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার তেজী ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স এর উপর ভর করেই।

কোভিডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দাবস্থার শিকার। সেখানে দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে অনাহার ও অপুষ্টি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু। গত মাসেই নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রথিতযশা কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পরামর্শ দিয়েছেন, দারিদ্র্য কাটাতে কী কী করা উচিত, তার শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে নিতে।

ক্রিস্টফ লিখেছেন, এই সব সমস্যা একসময় বাংলাদেশেরও ছিল। দেখে নাও, দেশটি কীভাবে সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। তিনি আরও লিখেছেন, ‘১৯৯১ সালে এক প্রলয়ংকরী ঝড়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তা সরেজমিনে দেখে আসার পর আমি লিখেছিলাম, এই দেশটি দুর্ভাগ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর। গত তিন দশকের অভাবিত অগ্রগতি প্রমাণিত করেছে সেদিন আমি ভুল লিখেছিলাম।’

বিগত এই সময়ে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন হয়েছে। আমরা জানি, আমাদের এই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি ফরেন রেমিট্যান্স। যা বেশির ভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের রক্ত পানি করা পরিশ্রম থেকে। পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত ফরেন রেমিট্যান্স যখন হুমকির মুখে তখন জনশক্তি রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স এর উপর ভর করেই টিকে আছে দেশের অর্থনীতি।

গত বছর বিশ্ব ব্যাংক ধারণা করেছিল, বাংলাদেশ ফরেন রেমিট্যান্স থেকে আয় করতে পারে ১৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ আয় করেছে ২১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই শক্তিশালী ভিত সবেধন নীলমনি ঐ প্রবাসী শ্রমিকেরাই। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা কতটা সম্মান করি জনশক্তি রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে যারা জড়িত তাদের আমরা কতটা মূল্যায়ন করি সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ ও ভিন্ন আলোচনার বিষয়। আমি শুধু আজকে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের একটা বিষয়ে আলোকপাত করবো।

ধরা যাক, একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে জনশক্তি রপ্তানি করে তার প্রতিটি ভিসা কেনা বাবদ খরচ হয় গড়ে দেড় লাখ টাকা। এই ভিসার মেয়াদ থাকে তিনমাস। ভিসা প্রসেস হয়ে অর্থাৎ ভিসা প্রিন্টিং। এরপর সে দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ভিসার সঠিকতা যাচাই করে সত্যায়িত হয়ে দেশে আসতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই মাস। ভিসা এলে শ্রমিকদের টাকা পয়সা জোগাড় করতে আরও পনের-বিশ দিন সময় লেগে যায়। এরপর হাতে সময় থাকে সবমিলিয়ে দশ থেকে পনের দিন। অর্থাৎ, এই পনের দিনের মধ্যেই শ্রমিককে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাই করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ফ্লাই করার আগে ফিংগার প্রিন্ট দেয়া ও মেডিকেল চেকআপ করা ছাড়াও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে। এই বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে এক কথায় ম্যানপাওয়ার করা বলা হয়। ম্যানপাওয়ার করা ও শ্রমিকের জন্য আলাদা স্মার্ট কার্ড তৈরির কাজগুলো সম্পন্ন করে ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি)। লকডাউনের কারণে যদি এই বিএমইটি বন্ধ থাকে তাহলে শ্রমিক রপ্তানি সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, শেষের এই ১০/১৫ দিন সময়ের মধ্যে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে শ্রমিক কাজে যোগদান করতে প্রবাসে চলে যান। আর যদি এই সময়ের মধ্যে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র পাওয়া না যায় তবে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর ফরে ভিসা কেনার পুরো টাকা ক্ষতি হয়ে যায়।

মনে করা যাক, একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক হয়তো সারাবছর চেষ্টা করে তিনশ’ ভিসা কিনতে করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রত্যেকটা ভিসা কিনতে তার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এতে তার মোট খরচ হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা। এখন বিএমইটি যদি করোনার জন্য বন্ধ থাকে তাহলে একজন ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা। একজন জনশক্তি রপ্তানিকারকের পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতির ভার বহন করা সম্ভব নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এই ক্ষতির ভার গিয়ে পরবে প্রান্তিক শ্রমিকদের উপর। এরা বিদেশে যেতে নিজের জমি বা গরু ছাগল বিক্রি করে টাকা যোগাড় করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বিদেশ যাওয়ার জন্য সুদের বিনিময়ে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন।

আমাদের হিসেব মতে, বিএমইটি বন্ধ থাকার কারণে ভিসা পেয়েও বিদেশে যেতে পারছে না প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। দুই লাখ শ্রমিকের আর্থিক হিসাব করে দেখা যায় রাষ্ট্রের ক্ষতি গিয়ে দাঁড়ায় কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রের এই বিপুল পরিমাণ সরাসরি আর্থিক ক্ষতি ও সম্ভাব্য রেমিট্যান্স বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষতি পোষাতে শিগগিরই ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) খুলে দেয়া দরকার। অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের মতো করে বিএমইটি চালু রাখা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিএমইটি যেন ভিসা হাসপাতাল।

লেখক পরিচিতি: আবু রায়হান সরকার; নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ট্যুরিজম রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)