প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার: তোমার তীব্র চেতনায়, ঘুরে ঘুরে আবার জাগ্রত হই।
তোমার দীপ্ত চাহনির আগুনে জ্বালিয়ে দিতে চাই,
শাসকের ঐ ময়ুর সিংহাসন।
ও চে, তুমি এ দেশে ঘরে ঘরে জন্ম নাও।
তোমার ক্রোধ আর বেদনার মিশ্র চাহনী থেকে যে শক্তি আমি পাই,
তা প্রতিটি তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে ছড়িয়ে দাও।
ও চে, তুমি এ দেশে ঘরে ঘরে জন্ম নাও।
মহাবিপ্লবী তোমায় জানাই লাল সালাম।
তোমার চরণে আমার প্রণাম।
আর্নেস্তো চে গুয়েভারার জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। তিনি শহীদ হন ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। চে গুয়েভারা ছিলেন আর্জেন্টাইন মার্কসবাদী বিপ্লবী, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, যুদ্ধ বিশারদ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র চে গুয়েভারা কিউবার মাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব।
তার প্রকৃত নাম ছিল আর্নেস্তো গুয়েভারা দ্য লা সের্না। তবে তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান চে গুয়েভারা বা চে নামেই। নামের পাশাপাশি তার মুখচিত্রটি সার্বজনীন হয়ে ওঠে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় জুড়ে বিশ্বের তরুণদের কাছে বিপ্লব ও বিদ্রোহের প্রতিক হিসেবে চে গুয়েভারার সেই মুখচ্ছবিটি সমাদৃত।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চে ছিলেন সবার বড়ো। তার বাবা স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের গোড়া সমর্থক ছিলেন। সেই সংঘর্ষের সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে দিতেন।
ছোটবেলা থেকেই চে ছিলেন অস্থির, চঞ্চল। তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, আইরিস বিদ্রোহের রক্ত বইছে তার এই ছেলের শিরায় শিরায়। একটি সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠায় শৈশবেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি তিনি সহমর্মী ছিলেন।
১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন।
চে ভুগতেন হাঁপানিতে। তবে তিনি ছিলেন দারুণ মল্যবিদ। তার পছন্দের তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল, গলফ আর শ্যুটিং। চে গুয়েভারা ছিলেন সাইক্লিস্ট। তিনি রাগবি ইউনিয়নের আগ্রহী সদস্য ছিলেন। বুয়েনস আয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছেনও। রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে ফিউজার নামে ডাকা হত। তার বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকতেন চানচো (শুয়োর) বলে। কারণ, তিনি অনিয়মিত গোসল করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন।
বয়োঃসন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। পাবলো নেরুদা, জন কিটস, আন্তনিও মারকাদো, ফ্রেডরিকো গার্সিয়া লোরকো, গ্যাব্রিয়াল মিনস্ট্রাল ও এয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা তিনি দারুণ পছন্দ করতেন। এদের কবিতা আবৃত্তি করতেন অসাধারণ।
পারিবারিকভাবেই চে গুয়েভারা ছিলেন বইপোকা। বাড়িতে ছিল ৩ হাজারেরও বেশি বই। তিনি কার্ল মার্কস, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সলগারি, রবার্ট ফ্রস্টের পাশাপাশি বাদ দেননি জওহর লাল নেহেরুর বইও।
তরুণ বয়সে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ঘুরে বেরিয়েছিলেন। সে সময় ওই অঞ্চলের দারিদ্র্য তার মনে গভীর রেখাপাত করে। ভ্রমণে তার অভিজ্ঞতা হয়, ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ হলো, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নয়া উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদি আধিপাত্য।
তিনি ভাবলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র সমাধান বিশ্ব বিপ্লব। তাই তিনি গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট জ্যাকাবো আর্বেঞ্জ গোজম্যানের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হলেন।
সিআইএ ১৯৫৪ সালে গোজম্যানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই ঘটনায় চে তার ভাবনাকে আরও শাণিত করেন।
গুয়াতেমালায় প্রেসিডেন্ট গোজম্যান ক্ষমতাচ্যুত হলে চে চলে যান মেক্সিকোতে। সেখানেই, ১৯৫৪ সালে পরিচয় রাউল ক্যাস্ত্রো ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে। কিউবায় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে একনায়কতন্ত্র গড়ে তুলেছেন ফুলজেনসিও বাতিস্তা। দুই ভাই তখন কিউবান একনায়ক বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।
চে বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলনে রাউল ও ফিদেলের সাথী হলেন। সাগর পথে ঢুকলেন কিউবায়। খুব অল্প সময়েই বিপ্লবী সংঘে চে তার নিজের অবস্থান তৈরি করে নেন। মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনায় তিনি বিপ্লবী সংগঠনটির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হলেন।
কিউবান বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ার স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে কোন নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পান সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। সামরিক বাহিনীতে তিনি ইনস্টাকশনাল ডিরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। শিল্প উদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন করেন। যৌথ খামার গড়ার ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে।
সামরিক বাহিনীর ইনস্টাকশনাল ডিরেক্টর হিসেবে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতেন। এই বাহিনীকে নিয়েই তিনি কিউবাকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন পিগ উপসাগর।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ব্যালেস্টিক মিসাইল আনতে উদ্বুদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে।
১৯৬৪ সালে তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। ১১ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে তিনি আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তাতে তিনি দক্ষিণ জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। এটাকে বন্ধ করতে জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন। বক্তৃতায় তিনি কালো মানুষদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। উত্তেজিত হয়ে তিনি ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হ্যাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণার উল্লেখ করে বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন, তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা । বক্তব্য শেষ করেন ‘সারা বিশ্বের শোষিত মানুষের এখন একমাত্র চিৎকার, বিপ্লব অথবা মৃত্যু’ বাক্যটি দিয়ে।
শিরায় শিরায় যার বিপ্লবের নেশা, তিনি কতো দিন আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কঙ্গোর উদ্দেশে কিউবা ত্যাগ করেন। সেখানে খুব বেশি দিন থাকা হলো না। কিনশাসায় তিনি বিপ্লব সংঘটনে ব্যর্থ হলেন।
কিনশাসা থেকে পাড়ি জমালেন বলিভিয়ায়। এখানেই তিনি শিকার হলেন বিশ্বাসঘাতকতার। বন্দী হলেন সরকারি বাহিনীর হাতে।
গুয়েভারার অবস্থান সম্পর্কে তখন লোকজন জানত না। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৭ এর শুরুর দিকে জম্বিক স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির সাথে দার-উস সালাম নামক স্থানে দেখা হয়। সেখানে গুয়েভারা তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হাভানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের পদযাত্রায় এক মন্ত্রী বলেন, যে চে লাতিন আমেরিকার কোন জায়গায় বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপর জানা যায়, তিনি বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ক্যাস্ত্রোর পরামর্শে তিনি দুর্গম মন্টেন ড্রাই ফরেস্ট এলাকায় প্রশিক্ষণ চালান যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকরা তাকে সাহায্য করেছিলেন।
বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, তারা চে গুয়েভারাকে ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর দুপুর ১টা ১০ মিনিটে। মৃত্যুর সময়কাল এবং ধরণ নিয়ে মতভেদ এবং রহস্য এখনও আছে।
ধারণা করা হয়, ১৯৬৭ সালের এই দিনটিতে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গুয়েভারাকে। পরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে, বন্দী অবস্থায় নয়টি গুলি চালিয়ে আর্জেন্টাইন ‘সন্ত্রাসবাদীকে তারা মেরে ফেলেছে এক মদ্যপ সৈনিক।
তবে আরেকটি মত হচ্ছে, এই দিনের যুদ্ধে বন্দী হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পরবর্তীতে এইসব দাবির সপক্ষে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।
১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণকবরে চে ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
চে গুয়েভারা কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ। ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন ২৫টি। এছাড়া তিনি লিখে দিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাতকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০টি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহীত আছে ৭০টির মতো। তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলী।
লেখক পরিচিতি: প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার; সাবেক ছাত্র নেতা