মৃত্যু তাকে ছুতে পারেনি

0
793

পরিবহন শ্রমিকদের নির্মমতা কমবেশি সবাই দেখেছে। গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মারবে, বিচার করা যাবে না। অন্য গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে মানুষ মারবে, বিচার করা যাবে না। এদের দৌরাত্ম্য রোধে আইন হলো। সেই আইন তারা মানবে না। জনগণকে জিম্মি করেই ক্ষান্ত হলো না। হামলা চালালো নিরীহ মানুষের ওপর। তাদের নৃশংস হামলা থেকে বেঁচে গেলেন এক নারী। তার বেঁচে যাওয়ার কথা ফেসবুকে লিখলেন গণমাধ্যম কর্মী মনিরুল ইসলাম। তার লেখা প্রকাশ করা হলো আর্ট নিউজের পাঠকদের জন্য :

|| গাড়িশ্রমিকদের গনপিটুনি থেকে বেঁচে গেলেন যে নারী ||

বাড্ডার তাসলিমা রানুর কথা মনে আছে নিশ্চয়। ছেলেধরা গুজবে মুহুর্তেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সেরকম আরেকটা গনপিটুনির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল ঢাকার অদুরেই সাইনবোর্ড মোড়ে। হয়তো আমি সেখানে না গেলে শ্রমিকদের মারধরে মারায় যেতো মানুষটি।

বুধবার সকাল থেকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ করে বাস-ট্রাক শ্রমিকরা। শুধু অবরোধ নয়, শুরু হয় তাদের নৈরাজ্য। স্কুল কলেজের বাস-ভ্যান পর্যন্ত তাদের নৈরাজ্য থেকে বাদ যায়নি। সেই ঘটনা কভার করতে গিয়েছিলাম। বেলা ১২টার নিউজে সরাসরি সম্প্রচারের সময় দেখলাম, একজন নারীকে ৫০-৬০জন শ্রমিক মারমুখী হয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তায় আড়াআড়ি করে রাখা দুই বাসের মাঝখানে। আমি মিনিট খানেকের ভিতর লাইভ শেষ করে দৌড় দিয়ে গেলাম সেখানে। শ্রমিকরা গুজব ছড়ালো, সেই নারী নাকি ছুরি দিয়ে মারতে এসেছে। সেই গুজব মুর্হর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো সাইনবোর্ডের হাজার শ্রমিকের কাছে। আস্তে আস্তে ওই নারীকে মারতে সেখানে জড়ো হয় অন্তত দুশো মানুষ। আমি জানি না কী মনে করে, ঝাপিয়ে পড়ে, শ্রমিকদের ঠেলে ওই নারীর কাছে গিয়ে আগলে ধরলাম তাকে। পিঠে কয়েকটা কিল-ঘুষিও পড়ল তখন। শুরু করলাম ওই মারমুখীদের সাথে চিৎকার আর তর্ক। ওদের ভাষ্য, ওই নারী ছুরি দিয়ে শ্রমিক মারতে আসছে, তাই তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে। আমাকে তখন শত শত মানুষ বলছে, আপনি সরে যান, ওকে মেরেই ফেলবো। আমাকে সরাতে ধাক্কাও দিলো কয়েকজন। মারমুখী সবার তখন রক্তচক্ষু। এটা দেখে, আরো শক্ত হলাম। জানিনা কোন শক্তি আমার উপর ভর করেছিল তখন। একাই প্রায় ১০-১৫জন ধাক্কা দিয়ে সরালাম। আমি আমার পরিচয় দিয়ে, টিভি মাইক্রোফোন উচু করে বললাম, পারলে মহিলার গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, তারপর কী করি! জানি ওরা মারা শুরু করলে আমার কিছুই করার থাকবে না। ওরা মারা শুরু করলে মুহুর্তেই নিথর হয়ে যাবে হতভাগ্য এই নারী। এসব ভেবেই আরো শক্ত হয়ে দুই হাত দিয়ে আগলে দাড়ালাম। মিনিট ১৫ ধরে এরকম চিৎকার-চেচামেচির পর কয়েকজন দুরে সরতে থাকলো দু-একজন। টিভি সাংবাদিক ওই নারীকে ঠেকাতে আসছে এটা দেখে কেউ কেউ পিছিয়েও গেলো।
খানিকটা নিরাপদে এনে ওই ভুক্তভোগীকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু, অনেক মানুষের চিৎকারের আওয়াজে তার নাম ঠিকানা মনে নেই। শুধু মনে আছে সে বলছিল, ফেনী থেকে তার মুমুর্ষ মাকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালে আসছিল। পথে শ্রমিকদের অবরোধে আটকা পড়ে অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার হেঁটে, সাইনবোর্ডে আসে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে তার অ্যাম্বুলেন্স বের করে দেয়া যায় কিনা। এতোপথ হেটে আর মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ওই নারীর অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। এসময় আড়াআড়ি করে রাখা একটি বাসের হেল্পারের সাথে তার ঝগড়া হয়।
তারপরই রটানো হয়, তিনি নাকি ছুরি নিয়ে শ্রমিক খুন করতে এসেছে। এই গুজব ছড়িয়ে, তাকে গনপিটুনি দিতে উদ্যত হয় শতশত মানুষ। আমি কাল থেকেই ওই ঘটনা বারবার ভাবছি যে, নাম ভুলে যাওয়া ওই নারী নির্ঘাত মৃত্যু থেকেই বেচে গেছে হয়তো। আমিও আমার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে, শ্রমিকদের সাথে ঝগড়া ঠেলাঠেলি-হাতাহাতি-গালাগালি করে বাচাতে পেরেছি একজন মানুষকে। ওই নারীকে একদম নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে ক্লান্ত মিনিট খানেক হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। পরে ওই নারীকে আর খুজে পাইনি। তার একটা সাক্ষাতকার নেয়ার ইচ্ছে থাকলেও পাইনি তাকে। ???

ঘটনার সময় ছবিটি তুলেছেন ডেইলি স্টার পত্রিকার ফটো সাংবাদিক রাশেদ সুমন ভাই।